বেতার আদি অনন্ত। বেতার ছিল আছে থাকবে। ১৮৬৪ সালে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের তাত্ত্বিক প্রমাণের মধ্য দিয়ে মানুষের কল্পনার জগতে যে বেতার তরঙ্গের যাত্রা, বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু এবং ইতালির বিজ্ঞানী জি মার্কনি ১৮৮৫ সনে প্রায় একই সময় সে বেতার তরঙ্গ প্রেরক যন্ত্রের সাহায্যে দূরবর্তী স্থানে প্রেরণ করতে সক্ষম হলেন। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত সভ্যতা, ইতিহাস আর কালের প্রবাহে ঘটনাসূহের নীরব সাক্ষী এ বেতার।
Advertisement
১৯৪১ এর পার্ল হারবার আক্রমণের ঘটনা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা, মার্টিন লুথার কিংয়ের কালজয়ী ভাষণ আই হ্যাভ এ ড্রিম, মহাত্মা গান্ধীর সোলজার অব পিস বক্তৃতা ১৯৭১ সনে বাংলার জনপদে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণ এ জনপদে বেতার সম্প্রচারের সম্প্রচারে কালজয়ী এক প্রোজ্জ্বল অধ্যায়। বেতার এমনই এক গণমুখি বহুধারার সম্প্রচার মাধ্যম যা আবহমানকাল ধরে গণমানুষের চাহিদা ও প্রত্যাশার সাথে সম্পৃক্ত অনুষ্ঠান আর তথ্য প্রচারে এক অনন্য সাধারণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
বেতার তাই গণমানুষের সময় মতো জেগে ওঠার অন্যতম অনুষঙ্গ। কোনো নির্দিষ্ট জনপদে চর্চিত নিজস্ব ইতিহাস, কৃষ্টি, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য, ওই জনপদের সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় খুব সহজেই পৌঁছে দেওয়ার জন্য বেতারের ভূমিকা অনন্য অসাধারণ। এমনকি বিশ্ব সংস্কৃতির মিথস্ক্রিয়া ও সমৃদ্ধিকরণেও এ গণমাধ্যমটির রয়েছে অপরিহার্য ভূমিকা। এছাড়া তথ্য প্রবাহ, উন্নয়ন, জরুরি যোগাযোগ ও দুর্যোগকালীন যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেতারের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বেতারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, এর বিস্তৃতি ও প্রবেশ অন্য গণমাধ্যমের চেয়ে অনেক বেশি। বেতার স্বল্পমূল্যের সহজলভ্য সহজ বহনযোগ্য এমন এক মাধ্যম, যা দ্বারা বহুদূরের জনপদে এবং দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় সহজে ও দ্রুততার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। সময়ের পরিক্রমায় বেতারের অনুষ্ঠান নির্মাণ কৌশল যেমন বদলেছে তেমনি এর সম্প্রচার প্রকৌশলেও এসেছে ব্যাপক আধুনিক কাঙ্খিত পরিবর্তন। মিডিয়াম ওয়েভ ব্যান্ডের পরিবর্তে আধনিক এফএম ব্যান্ড প্রযুক্তি বেতার সম্প্রচারে যোগ করেছে বাড়তি নিবিড় মাত্রা। বেতরের এফএম সম্প্রচার বিশ্বব্যাপী বেতারকে করেছে আরও জনপ্রিয়।
আমাদের বেতারের পথচলা শুরু হয়েছিল ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র নামে ১৯৩৯ সনের ১৬ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের ৬২ নম্বর বাড়িতে। প্রথম ভেসে এসেছিল ত্রিলোচন বাবুর কণ্ঠস্বর। প্রথম সম্প্রচারিত গান ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ...জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে...। মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় ফ্রন্ট নামে খ্যাত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিল বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের সারথি। বিশেষ করে এখান থেকে সম্প্রচারিত জাগরণের গান আর চরমপত্র সংগ্রামী বীর বাঙালির আলোর দিশারী হয়ে কাজ করেছিল।
Advertisement
১৯৩৯ সনে শুরু করা ঢাকা বেতার কেন্দ্রকে পরবর্তীকালে ঢাকার শাহবাগে পুন:স্থাপন করা হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশে এটি বাংলাদেশ বেতার নামে পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে আগারগাঁও এ অবস্থিত এটি একটি রাষ্ট্রীয় আবশ্যকীয় সম্প্রচার মাধ্যম। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলাদেশ বেতার বাংলার আপামর জনসাধারণের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তথ্য ও বিনোদনের পাশাপাশি উন্নয়ন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিনোদন ও সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে বাংলাদেশ বেতার দেশের সামাজিক বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। যুগের পরিবর্তনে সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও ব্যাপকভাবে শুরু হয়েছে বেতারের এফএম সম্প্রচার। পাশাপাশি এখানে চালু হয়েছে নির্দিষ্ট কমিউনিটির জনসাধারণের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী ও গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিটি রেডিও সম্প্রচার যা ১৭টি কমিউনিটির মানুষের আশা আকাক্সক্ষা আর চাহিদার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। এর সাথে বর্তমানের অত্যাধুনিক ইন্টারনেট রেডিও, অনলাইন রেডিও, বেতার সম্প্রচারে যোগ করেছে সময়োপযোগী এক বর্ণিল আকর্ষণীয় মাত্রা। বেতার সম্প্রচারের সব প্রচেষ্টার সম্মিলনে আমরা বেতারকে সবখানে সবসময়ে সবার কাছে পৌঁছাতে চাই।
বিশ্বব্যাপী বেতার সম্প্রচারের উপযোগিতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিশ্বায়ন পরবর্তী ব্যস্ততম নাগরিক জীবনে প্রায় প্রতিটি দেশেই বেতার এখন তথ্য ও বিনোদনের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। জনগণের তথ্য অধিাকার নিশ্চিতকরণে এ গণমাধ্যমটির গুরুত্ব অনুধাবণ করেই জাতিসংঘের ইউনেস্কোর ৩ নভেম্বর, ২০১১ সাধারণ সভায় বিশ্ব বেতার দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। স্পেনের একাডেমিয়া এসপানোলা ডি লা রেডিও’ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার সংস্থা ও তাদের ইউনিয়নের সমর্থনে এ বিষয়ে গবেষণা পরিচালনা করে। সে পরিপ্রেক্ষিতে ইউনেস্কোর নির্বাহী বোর্ডের ১৮৭তম সেশনে স্পেনের স্থায়ী প্রতিনিধি আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব বেতার দিবস পালনের প্রস্তাব করলে ২০১১ সনের সেপ্টেম্বরে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়। ১৪ জানুয়ারি ২০১৩ জাতিসংঘের সাধারণ সভা আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ব বেতার দিবস পালনের ইউনেস্কোর সিদ্ধান্তটি অনুমোদন করে। মূলত ১৯৪৬ সনের ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জাতিসংঘ বেতার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে ২০১২ সন থেকে প্রতি বছর ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব বেতার দিবস পালিত হচ্ছে।
এ দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বেতার মাধ্যমের গুরুত্ব সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি, মানুষকে বেতার মাধ্যমে তথ্য প্রবেশাধিকার দেওয়া এবং দেশি ও বিদেশি গণমাধ্যমের মধ্যে আন্ত:সংযোগ আরো জোরদার করা। এছাড়া বেতার মাধ্যমকে সর্বাধিক ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নান রকম অনুষ্ঠান আয়োজন, বেতার অনুষ্ঠান বিনিময়, অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় অংশগ্রহণের কর্মসূচি নেওয়া। বেতারের রয়েছে পৃথিবীর দুর্গমতম স্থানে পৌঁছানোর অসামান্য শক্তি। বিশ্বের শতকরা ৯৫ ভাগ এলাকা বেতার সম্প্রচারের আওতাধীন। এ গণমাধ্যম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে এবং বিদ্যুতের সংকট একে বাধাগ্রস্থ করতে পারে না। সুস্থ, জ্ঞানী, শিক্ষিত, নিরক্ষর, প্রতিবন্ধী, পুরুষ, নারী, যুবা কিংবা গরিব মানুষের জন্য বেতারের দখিনা দুয়ার অবারিত। এর মাধ্যমে নাগরিকের মধ্যে সংলাপ, বির্তক এবং শিক্ষার বিস্তার ঘটানো সম্ভব। জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ সম্পাদন করা এবং দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেতারের ভূমিকা অনন্য। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নতুন প্রযুক্তি বেতারকে আরও সম্ভাবনাময় আকর্ষণীয় আবশ্যকীয় করে তুলেছে।
অবাধ তথ্যপ্রবাহের এ যুগে তথ্যের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও কল্যাণ নিশ্চিত করা সম্ভব। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে টেলিভিশন, ইন্টারনেট, প্রিন্ট মিডিয়াসহ সবধরনের গণমাধ্যমের সাথে প্রতিযোগিতা করে বেতারকে টিকে থাকতে হচ্ছে। বেতার প্রতিষ্ঠানগুলো অদূর ভবিষ্যতে আরো ডিজিটাল ব্রডকাস্ট যুগে প্রবেশ করবে এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্য, কৌশল, সংবাদ ও জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতার তার গৌরব ও ঐতিহ্য সমুন্নত রাখতে সক্ষম হবে। আর এ মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ ছোট্ট একটি যন্ত্রটি কম খরচে বহুমুখি কর্মকাণ্ড পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে ঘটাবে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বেতার সবসময়, সবকাজে, সবখানে, সবার জন্য। জয়তু বেতার।
Advertisement
লেখক : পরিচালক (প্রাক্তণ) কৃষি তথ্য সার্ভিস, খামারবাড়ি, ঢাকা ও কৃষি গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ।
এইচআর/জেআইএম