করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনের শহর থেকে এক সাংবাদিক নিখোঁজ হয়েছেন। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তার কোনো সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। চেন কুইউশি নামের ওই সাংবাদিক করোনাভাইরাস উপদ্রুত উহান শহরের করুণ দৃশ্য বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন।
Advertisement
করোনাভাইরাস সম্পর্কে আগেই সতর্ক করে দেয়া চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াংকের মৃত্যুর পরের দিনই তার নিখোঁজের খবরটি সামনে এল। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে শনিবার এ তথ্য জানানো হয়েছে।
পরিবারের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টা থেকে তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফোনে একাধিকবার রিং দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেনি।
সাংবাদিক কুইউশি তার প্রতিবেদনে উহান শহরে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস পরবর্তী শহরের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরেছিলেন। হাসপাতালে রোগী ও স্বজনদের আত্ম-চিৎকার, রোগীতে ঠাসাঠাসি হাসপাতালের পরিবেশ ও রাস্তায় পড়ে থাকা মরদেহ নিয়ে তৈরি তার প্রতিবেদনগুলো ছিল অত্যন্ত মানবিক আবেদনে ভরা ও মর্মস্পর্শী। তার একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, হুইল চেয়ারে মরে পড়ে থাকা স্বজনের পাশে বসে ফোনে আত্মীয়দের সঙ্গে বিলাপের সুরে কথা বলছেন।
Advertisement
গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়ে। এখন পর্যন্ত চীনের মূল ভূখণ্ড ও এর বাইরে মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮০৩ জনে। এর মধ্যে শুধুমাত্র হুবেই প্রদেশে ৭৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এখন পর্যন্ত প্রতিষেধকবিহীন এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৩৪ হাজার ৮০০ জন। এর মধ্যে চীনের হুবেই প্রদেশে ২৭ হাজার আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বের ২৮টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। ২০ হাজারেরও বেশি এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি। আর তাদের মধ্যে ১১৫৪ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
করোনাভাইরাস মৃতের সংখ্যা ২০০২ সালে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স (সিভিয়ার অ্যাকুইটি রেসপিরেটরি সিনড্রোম) ভাইরাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। সেসময় সার্স ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বিশ্বের ২৪টিরও বেশি দেশে মোট ৭৭৪ জনের মৃত্যু হয়। আর এতে আক্রান্ত হয় ৮ হাজার ৯৮ জন।
ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সরকারি কর্মকর্তারা করোনাভাইরাস আক্রান্ত এক ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে বের করে টেনেহিঁচড়ে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছেন। এমন অনেক ছবি ফাঁস হওয়ায় অস্বস্তিতে রয়েছে উহান কর্তৃপক্ষ
Advertisement
উহান থেকেই দেশটির ৩১টি প্রদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে এ ভাইরাস। উহান শহরে স্থানীয় সরকার বাস, ট্রেন, বিমান সব বন্ধ করে দিয়েছে। দোকানপাট বন্ধ। সবার জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চলছে শীতকালীন ছুটি। ফলে ক্যাস্পাস ফাঁকা, উহান শহরটা একদম জনশূন্য। আতঙ্ক এবং উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে সবার মাঝে। এসব্ নিয়ে উহানের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরে মানবিক আবেদনমূলক প্রতিবেদন তৈরি করছিলেন সাংবাদিক কুইউশি।
নিখোঁজ এই সাংবাদিক তার পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে উহান শহরের প্রধান প্রধান হাসপাতাল, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াস্থল এবং আবাসিক এলাকাগুলোতে গিয়ে রোগী ও তার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন। এরপর এই ভিডিওগুলো টুইটার ও ইউটিউবে ছেড়ে দিতেন। তবে চীনে টুইটার, ইউটিউব নিষিদ্ধ থাকায় তিনি বিশেষ সফওয়্যার ব্যবহার করে এগুলো আপলোড করতেন এবং দেখা যেত।
উহান কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে নিখোঁজের আগে এক পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘স্টেডিয়ামে একসঙ্গে ১ হাজার ব্যক্তির শয্যার ব্যবস্থা করে দেয়া সহজ, তবে এই এক হাজার লোক একসঙ্গে খাবে কীভাবে? এতগুলো মানুষের গোসলের ব্যবস্থা কীভাবে করা হবে, তারা টয়লেটে যাবে কীভাবে? তাদের কি ২৪ ঘণ্টায় মাস্ক পরিয়ে রাখতে হবে?
আরেকটি ভিডিওতে তিনি দেখান, কীভাবে হাসপাতালের ভেতরে-বাইরে অবাধে মাস্ক ছাড়াই যে কেউ ঢুকে যাচ্ছে। হাসপাতালে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ।
সাংবাদিক কুইউশি নিখোঁজের পর তাকে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন তার পরিবার ও স্বজনরা। তার এক বন্ধু সিএনএনকে বলেছেন, ‘নিখোঁজের আগে সে একদম স্বাভাবিক ও সুস্থ ছিল। এখন আমাদের আশঙ্কা হচ্ছে, তাকে যেখানে রাখা হয়েছে সেখান থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত না হয়ে যায়।’
সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর ভিডিও প্রকাশের জেরে ফাং বিন নামের কুইউশির এক সহকর্মী গ্রেফতার হন। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, করোনাভাইরাসে মৃতদের মরদেহ বাসে লোড করা হচ্ছে। বর্তমানে তিনি এই মামলায় জামিনে রয়েছেন।
এদিকে চীনে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সম্পর্কে আগেই সতর্ক করে দেয়া চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং মারা গেছেন। বৃহস্পতিবার ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল উহানে মারা যান তিনি। গত ১২ জানুয়ারি তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শরীরে করোনাভাইরাসের বিষয়টি ধরা পড়ে ১ ফেব্রুয়ারি। রোগীর দেহ থেকে লির শরীরে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে।
লি ওয়েনলিয়াং এ ভাইরাস দেখা দেয়ার শুরুতে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, সার্সের মতো মহামারি আকার ধারণ করতে পারে এই নতুন ভাইরাস। তবে তখন তার সে কথায় পাত্তা দেয়নি দেশটির কর্তৃপক্ষ। পাল্টা তাকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে হুমকি দেয়া হয়।
লি একজন চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ। কর্মরত ছিলেন উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালে। ডিসেম্বরে সাত ব্যক্তির শরীরে তিনি নতুন এই ভাইরাসটি শনাক্ত করেন এবং ভেবেছিলেন এটা সার্সের মতো মহামারি আকার ধারণ করতে পারে, যেটা ২০০৩ সালে দেখা গিয়েছিল।
এসআর/পিআর