বরিশালের গৌরনদীতে হেলাল শিকদার (২৫) নামে চীন ফেরত এক মেডিকেল শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গুজবের কারণে ওই শিক্ষার্থীর পরিবার অনেকটা একঘরে হয়ে পড়েছে।
Advertisement
ভুক্তভোগী পরিবার সূত্রে জানা যায়, গৌরনদী পৌরসভার উত্তর পালরদী এলাকার সৌদি প্রবাসী জালাল শিকদারের ছোট ছেলে হেলাল শিকদার ডাক্তারি পড়ার জন্য ২০১৫ সালে চীনে যান। হেলাল চীনের সাংহাই থংচি ইউনিভার্সিটির চিকিৎসা বিজ্ঞান বিভাগের দশম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী। বর্তমানে ছুটিতে হেলাল তার উত্তর পালরদী এলাকার বাড়িতে অবস্থান করছেন। এছাড়া ওই বাড়িতে হেলালের মা মেরিনা বেগম (৫০) , বোন নিপা বেগম (৩২), ছোট বোন আখি বেগম (১৭) বসবাস করেন। হেলালের বড় ভাই বেল্লাল শিকদার (৩৫) ঢাকায় থাকেন। আরেক বোন পাখি বেগম (২১) থাকেন শ্বশুর বাড়িতে। তাদের বাবা জালাল শিকদার সৌদি আরবে থাকেন।
গত ১ ফেব্রুয়ারি হেলাল শিকদার চীন থেকে বাড়িতে ফেরেন। হেলাল শিকদারের চীন থেকে ফিরে আসার খবর জানাজানি হলে রোববার (২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যার পর ওই এলাকায় তাকে নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়ে। হেলাল সিকদার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত, তার সঙ্গে কেউ কথা বললে কিংবা কাছে গেলে সেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবে, এমনকি হেলালের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কেউ কথা বললেও এ রোগ ছড়িয়ে পড়বে। এ ধরনের গুজবকে কেন্দ্র করে এলাকার লোকজনদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক দেখা দেয়। এরপর হেলালের পরিবারের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন প্রতিবেশীরা। সংক্রমণের ভয়ে হেলালের বাড়ির পাশ দিয়ে চলাফেরাও করছেন না প্রতিবেশীরা। এলাকার রিকশা চালকরা ওই পরিবারের কোনো সদস্যকে ভয়ে রিকশায় তুলছেন না। এসব কারণে এক সপ্তাহ ধরে অনেকটা একঘরে হয়ে রয়েছে হেলালের পরিবার।
এদিকে এই গুজবের মধ্যে অনেকটা আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেলালকে নিয়ে ছড়িয়ে পড়া কিছু ভুয়া নিউজ। ওই নিউজ ফেসবুকে পোস্ট দেয়ার পর সেখানে কয়েকজন হেলালকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছেন।
Advertisement
চীনে সহপাঠীদের সঙ্গে হেলাল শিকদার
গুজব ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন হেলাল শিকদার। ফেসবুক লাইভে এসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে মন্তব্য করে এ ধরনের প্রচারে কান না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
হেলাল বলেন, চীন থেকে বাংলাদেশে আসার পর একাধিকবার আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। কোনো পরীক্ষায় আমার মধ্যে ভাইরাস শনাক্ত হয়নি। এরপরও আমাকে নিয়ে বিভিন্ন গুজব ছড়িয়ে পড়েছে, যেগুলো জনমনে আতঙ্ক তৈরি করছে। যেমন ফেসবুকে আমি একটি পোস্ট দেখলাম - ‘হেলাল সিকদার চীন থেকে এসে নিজ বাড়িতে আত্মগোপন করায় এলাকাবাসীর মাঝে করোনাভাইরাস আতঙ্ক বিরাজ করছে’। অথচ সত্যিটা হলো- চীন থেকে আসার পর আমি নিজ বাড়িতেই অবস্থান করছি। পুলিশ সদস্যরা এসে আমার সঙ্গে দেখা করে গেছেন। বাড়িতে এসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে গেছেন একদল চিকিৎসক। এছাড়া এনএসআই, ডিএসবি ও ডিবির কর্মকর্তারা নিয়মিত আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তারপরও এই ভুয়া খবরগুলোর কারণে পারিবারিকভাবে এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে।
হেলালের বোন নিপা বেগম জানান, তার ভাইকে চীনে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর তারা দেশে ফেরার অনুমতি দিয়েছেন। দেশে ফিরেও তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়নি। এরপরও কিছু লোকজন হেলালকে নিয়ে গুজব রটাচ্ছে।
Advertisement
তিনি আরও বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বলতে গেলে আমাদের পরিবার অনেকটা একঘরে থাকার মতো জীবনযাপন করছে। এলাকার লোকজন আমাদের পরিবারের সদস্যদের এড়িয়ে চলছে। দেখা হলে কথা বলছেন না। দূর থেকে তারা নানা ধরনের কথা বলছেন। আমাদের অসহায়ত্ব কাউকে বুঝাতে পারি না। আমরা অসহায় জীবনযাপন করছি।
হেলাল শিকদার জানান, চীন থেকে দেশে ফেরার আগে সাংহাই থংচি ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। এরপর তারা দেশে ফেরার অনুমতি দেন। গত ৩১ জানুয়ারি রাতে বাংলাদেশে আসতে চীনের সাংহাই বিমানবন্দর থেকে শ্রীলঙ্কা এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে উঠি। বিমানে ওঠার আগে সেখানে নানা ধরনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন একদল চিকিৎসক। এছাড়া জ্বর ও হালকা সর্দি-কাশি হয়েছিল কি-না এসব জেনে বিমানে উঠতে দেয়া হয়। সাংহাই থেকে বিমান উড্ডয়ন করে রাত ১২টা ২০ মিনিটে। এরপর শ্রীলঙ্কার কলম্বো ট্রানজিট করা হয়। সেখানেও একইভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়। নাম-ঠিকানা, চীনে কি করি, কত বছর সেখানে- এসব তথ্যাদি লিপিবদ্ধ করে রাখেন তারা। ১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান অবতরণ করে। সেখান থেকে গৌরনদীর বাড়িতে আসি। এ পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।
তিনি আরও বলেন, গত ২ ফেব্রুয়ারি আমাকে নিয়ে এলাকায় নানা গুজব ছড়ানো হয়। গুজবের কারণে ওই দিন রাতে গৌরনদী থানা পুলিশের একটি দল আমাদের বাড়িতে আসেন। আমার সঙ্গে তারা কথা বলেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষার বিভিন্ন কাগজপত্র খতিয়ে দেখেন। পুলিশের ওই দলটি বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার সময় স্থানীয় কিছু লোকজনকে ডেকে বিভ্রান্তিকর কোনো তথ্য না ছড়াতে অনুরোধ করেন।
চীনে সহপাঠীদের সঙ্গে ল্যাবে হেলাল শিকদার
হেলাল শিকদার বলেন, গত ৩ ফ্রেব্রুয়ারি জেলা সিভিল সার্জনের নির্দেশে চিকিৎসকদের একটি দল তার বাড়িতে আসে। তারা পুনরায় স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। পরীক্ষার পর তার শরীরে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নেই বলে চিকিৎসক দলটি জানান। এত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও গুজব ছড়িয়েছে আমি না-কি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। সে কারণে এলাকার লোকজন আমার পরিবারের সদস্যদের আতঙ্কের চোখে দেখছেন। কানা-ঘুষা করছেন। বাড়ির বাইরে গেলে আমার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছেন না তারা। পরিবারের সদস্যদের নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হচ্ছে। এমনকি এলাকার রিকশা চালকরা তার পরিবারের সদস্যদের রিকশায় তুলছেন না। এ ধরনেরও কথা শুনেছি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে আমাকে মেরে ফেলা হবে।
গৌরনদী থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) খাইরুল আলম বলেন, হেলালকে নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই। তাকে নিয়ে গুজব ছড়ানো থেকে বিরত থাকার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন জানান, হেলালের বাসায় চিকিৎসকের একটি দল গিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেছেন। পরীক্ষাতে তার শরীরে করোনাভাইরাসের উপসর্গ ধরা পড়েনি। জ্বর ও হালকা সর্দি-কাশিও নেই হেলালের। তাছাড়া হেলাল একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী। তিনি নিজেও অনেক স্বাস্থ্য সচেতন। হেলাল বাড়িতে আলাদা একটি কক্ষে আইসোলেশন ওয়ার্ডের মতো ব্যবস্থা করেছে। সেখানে তিনি অবস্থান করছেন। ১৪ দিন পরিবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছেন হেলাল। তাকে নিয়ে ভীতি বা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।
গৌরনদী পৌরসভার মেয়র হারিছুর রহমান হারিছ বলেন, বেশ কিছুদিন ব্যক্তিগত কাজে ঢাকায় ছিলাম। সেখানে থাকা অবস্থায় হেলালকে নিয়ে গুজবের বিষয়টি আমার কানে এসেছে। এটা উদ্বেগের বিষয়। আগামী দু-একদিনের মধ্যে ওই এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে গুজব প্রতিরোধে যা যা করণীয় তাই করবো।
বরিশালের পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, চীন থেকে ফেরার পর হেলাল শিকদারের বাড়িতে পুলিশ পাঠানো হয়েছিল। এছাড়া চিকিৎসকদের একটি দলও তার বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাদের দেয়া তথ্য মতে হেলাল শিকদার একজন সুস্থ মানুষ। তাকে নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। তাই তাকে নিয়ে কোনো ধরনের গুজবে কান দেয়া জনগণের উচিত হবে না।
পুলিশ সুপার বলেন, হেলাল শিকদার ও তার পরিবার গুজবের কারণে যাতে কোনো ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য ওই এলাকায় জনসচেতনামূলক কর্মকাণ্ড চালাতে গৌরনদী থানা পুলিশকে নির্দেশ দেয়া হবে।
আরএআর/পিআর