*** কৃষকদের ফসলি জমিতে চেয়ারম্যানের বিলাসবহুল বাগানবাড়ি*** গ্রামের একাধিক কৃষকের জমি দখল করেছেন চেয়ারম্যান*** জমি না ছাড়লে, পুলিশকে জানালে হামলা-মামলা-নির্যাতন*** বাগানবাড়ির প্রবেশ পথে তৈরি করেছেন পাকা সড়ক*** চেয়ারম্যানের হাত থেকে রক্ষা পাননি খোদ ইউপি সদস্যরাও
Advertisement
কৃষকদের ফসলি জমি দখল করে বিলাসবহুল বাগানবাড়ি বানিয়েছেন নরসিংদী সদর উপজেলার মেহেরপাড়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল হাসান। বর্তমানে তিনি মেহেরপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান।
বাগানবাড়ির সৌন্দর্য বর্ধনে তিন বিঘা জমিতে পুকুর খনন করেছেন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসান। বাগানবাড়ির প্রবেশ পথে তৈরি করেছেন পাকা সড়ক। এজন্য স্থানীয় একাধিক কৃষককে জমি ছাড়তে হয়েছে। কৃষকদের জমি জবরদখল করে এসব বানিয়েছেন চেয়ারম্যান। জমি না ছাড়লে কিংবা দখলে বাধা অথবা থানা পুলিশের কাছে গেলে কৃষকদের ওপর নেমে আসে হামলা-মামলা ও নির্যাতন। চেয়ারম্যানের হাতে-পায়ে ধরেও জমি রক্ষা করতে পারেননি কোনো কোনো কৃষক।
তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মেহেরপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসান। তার দাবি, দুই বিঘা জমি ভাড়া আর বাকি সব জমি নিজস্ব। জমি কিনে বাগানবাড়ি বানিয়েছি। কৃষকদের কাছ থেকে কেনা জমিতে পুকুর ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করেছি। এসব আমার কেনা জমি।
Advertisement
অবশ্য এর আগে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জমি দখলের অভিযোগে চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসানের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন দেলোয়ার হোসেন নামে এক কৃষক।
পাশাপাশি চেয়ারম্যানের নানা অনিয়ম তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, দুদক চেয়ারম্যান, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও ইউএনওর কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন একই ইউনিয়ন পরিষদের চারজন সদস্য।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, একসময় ইসলামী আন্দোলনের ছাত্রসংগঠন ইসলামী শাসনতন্ত্রের নেতা ছিলেন বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতা মাহবুবুল হাসান। সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মো. জাকারিয়ার হাত ধরে ছাত্রলীগে ঢোকেন তিনি। ২০১৫ সালে নরসিংদী সদর উপজেলার মেহেরপাড়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মাহবুবুল হাসান। ২০১৬ সালে স্থানীয় এমপি আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপের আশীর্বাদে চেয়ারম্যান হন তিনি।
এরপর আর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজস্ব বাহিনী গঠন করে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসান। কৃষকদের জমি দখল করে বাগানবাড়ি বানিয়ে আবারও আলোচনায় আসেন তিনি।
Advertisement
স্থানীয়রা জানায়, চৌয়া গ্রামের কৃষকদের কয়েক বিঘা ফসলি জমি দখল করে নেন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসান। ওসব জমিতে বানানো হয় বিলাসবহুল বাগানবাড়ি। ছয় বিঘা জমির ওপর বাগানবাড়ি করতে একাধিক কৃষকের জমি দখল করেছেন তিনি। যারা জমি দিতে বাধা দিয়েছেন তাদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন।
চৌয়া গ্রামের ভুক্তভোগী কৃষক আবুল হোসেন বলেন, চেয়ারম্যানের অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুললে রাতে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ। জেলে বাকি জীবন কাটাতে হবে। বউ-বাচ্চা না খেয়ে মরবে। এর চেয়ে ভালো মুখ বুঝে সহ্য করি।
একই গ্রামের রহিমা বেগম বলেন, বাগানবাড়ি তৈরি করতে আমার তিন কানি জমি দখল করেছেন চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসান। যেখানে এখন পুকুর খনন করা হচ্ছে সেটি আমার জায়গা। পারিবারিক বিষয় নিয়ে বিচারের নামে আমার স্বামী ও ছেলেকে অনেক মারধর করেছেন চেয়ারম্যান। পরে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা ধার্য করেন। কিন্তু এত টাকা দেব কিভাবে। তখন চেয়ারম্যান আমার তিন কানি জমি বিক্রি করতে বলেন। আমি বললাম এত জমি বিক্রি করব না। তখন তিনি বলেন ভাড়া দিতে। এতেও রাজি না হলে জোর করে জমি দখলে নিয়ে পুকুর খনন শুরু করেন চেয়ারম্যান।
একই গ্রামের ভুক্তভোগী মো. জাহাদ আলী বলেন, চেয়ারম্যানের বাগানবাড়ির ভেতরে আমার সাড়ে ১৫ শতাংশ বসতভিটা রয়েছে। চেয়ারম্যান আমাকে ডেকে বলেছেন আমার জমিটি তাকে লিখে দিতে। আমার বাড়ির জন্য তার বাগানবাড়ির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। জায়গাটি লিখে দেইনি বলে আমার বাড়ির চারদিকে বেড়া দিয়ে রেখেছেন চেয়ারম্যান। এখন আমি বাড়ি নির্মাণের জন্য ইট-বালু কিছুই আনতে পারছি না। রাস্তায় ইটের ট্রাক আটকে দেয়, বিদ্যুতের খুঁটি থেকে লাইন দিচ্ছে না চেয়ারম্যানের লোকজন।
মুজিবুর রহমান নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, আমার সাড়ে ২২ শতাংশ জমির ১৪ শতাংশ দখল করে বাগানবাড়িতে পুকুর খনন করেছেন চেয়ারম্যান। আমাকে একবারের জন্যও কিছু বলেননি তিনি। মুখ খুললে বাকিটুকুও যাবে।
এদিকে চেয়ারম্যানের দখলের হাত থেকে রক্ষা পায়নি আছিয়া বেগমদের পাঁচ ভাই-বোনের বসতভিটার জমিও। তাদের বসতভিটা দখল করে নিয়েছেন চেয়ারম্যান।
আছিয়া বেগম বলেন, চেয়ারম্যানকে বলেছি, আমাদের বসতবাড়ি হারালে বস্তিতে গিয়ে থাকতে হবে। চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে বলেছি কতবার। এরপরও চেয়ারম্যানের মনে দয়া হয়নি। আমাদের বাড়ি থাকলে নাকি তার বাগানবাড়ির পরিবেশ নষ্ট হবে। এজন্য দখল করে নিয়েছেন। এখন আমরা কি করব। কার কাছে বিচার দেব।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফসলি জমির মাটি বিক্রি করা হয় ইটভাটায়। দলীয় প্রভাবে স্কুলের জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে আওয়ামী লীগের কার্যালয়। শুধু গ্রামের কৃষকই নয়, চেয়ারম্যানের হাত থেকে বাদ পড়েননি খোদ ইউপি সদস্যরাও। অবশেষে চেয়ারম্যানের অপকর্মের বিষয়ে মুখ খুললেন তারা।
মেহেরপাড়া ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের সদস্য দানিছুর রহমান দানা বলেন, চেয়ারম্যান যেখানে বাগানবাড়ি করেছেন সেখানে অল্প কিছু জমি কিনেছেন। এসব জমির অধিকাংশই কৃষকদের। তাদের জমি জবরদখল করে রঙ্গমঞ্চ ও জলসাঘর, বাগানবাড়ি ও পুকুর খনন করেছেন চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যানের বিশেষ বাহিনী আছে। কৃষকদের হুমকির ওপর রাখেন। স্কুলের জায়গায় দলীয় কার্যালয় দিয়েছেন তিনি। ভয়ে তার বিরুদ্ধে কথা বলে না কেউ।
এর আগে জমি দখলের অভিযোগে চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসানের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ১৯৮৪ সাল থেকে আমি আওয়ামী লীগ করি। চেয়ারম্যান যখন আমার জমি দখল করে নিয়েছেন তখন থেকে এলাকায় আর আওয়ামী লীগের পরিচয় দেয়া যায় না। দলের পরিচয় দিলে মানুষ হাসে, লজ্জা দেয়। পুলিশ ও জেলা প্রশাসনসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ে বার বার অভিযোগ দিয়েও কোনো কাজ হয়নি।
এসব বিষয়ে মেহেরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহবুবুল হাসান বলেন, আমার নিজস্ব এবং কেনা জমিতে বাগানবাড়ি বানিয়েছি। সেখানে দুই বিঘা জমি ভাড়া নিয়েছি, বাকিগুলো আমার কেনা। প্রতিপক্ষরা ষড়যন্ত্র করে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছে। কৃষকদের জমি দখলের কোনো প্রমাণ নেই।
তিনি আরও বলেন, কাগজ যার জমি তার। এটাই বাস্তবতা। এখানের সব জমির কাগজপত্র রয়েছে আমার। আমি বিচারক। আমি যদি রক্ষক হয়ে ভক্ষণ করি তাহলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
সঞ্জিত সাহা/এএম/এমকেএইচ