বিনোদন

মুনীর চৌধুরীর সেই নাটকে শেখ কামালের বাবা ছিলাম : মহসীন

অভিনয়ে প্রশংসনীয় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর একুশে পদক পেতে যাচ্ছেন প্রবীণ অভিনেতা এস এম মহসীন। প্রায় চার দশকের অধিক সময় ধরে অভিনয় করে যাচ্ছেন তিনি। দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন শিল্পকলা একাডেমিতে। পাশাপাশি শিক্ষকতাও করেছেন জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।

Advertisement

বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে জাগো নিউজের কাজে পুরস্কার পাওয়ার অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন এই গুণী অভিনেতা। পাশাপাশি কথা বলেছেন তার অভিনয় জীবনের নানা বিষয় নিয়ে। তুলে ধরা হলো আলাপের চুম্বক অংশ।

জাগো নিউজ : এই বছর অভিনয়ের জন্য একুশে পদক পাচ্ছেন আপনি। খবরটি পেয়ে কেমন লাগছে?এস এম মহসীন : আমি একজন ক্ষুদ্র মানুষ। এমন স্বীকৃতিতে অনেক খুশি হয়েছি। ভালোলাগার সবচেয়ে বড় কারণ হলো পুরস্কারটি আমাকে অভিনেতা হিসেবেই দেওয়া হয়েছে। লেখাপড়া করেছি নাট্যকলা নিয়ে। শিক্ষকতাও করেছি। শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি করেছি। নাটকের সঙ্গে কাটিয়েছি পুরো জীবনটা। কিন্তু প্রচারের চেয়ে কাজ নিয়ে মেতে থাকতেই পছন্দ করেছি সবসময়। সেই কাজের মূল্যায়ন করেছে সরকার, রাষ্ট্র। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

জাগো নিউজ : যে কাজের জন্য এই সম্মান পেতে যাচ্ছেন, সেই অভিনয়ের ঝোঁক কীভাবে ও কবে তৈরি হয়েছিলো প্রথম?এস এম মহসীন : ক্লাস টু তে পড়ি তখন চাঁদপুরে। টিপু সুলতান নাটকে অভিনয় করেছিলাম। ক্লাস সেভেনে ওঠার পর থেকে প্রতিবছরই নাটক করেছি। কলেজে নাটক করেছি। তখন সবাই আমাকে নাটকের মানুষ হিসেবে জানতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়ি তখন মুনীর চৌধুরী স্যার জীবীত ছিলেন। সেই সময় তার কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ছিলেন। আর আমি ছিলাম বাংলা বিভাগের ছাত্র। তার নাটক নিয়ে আমরা কলকাতায় গেছি। সেই নাটকে বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামালও অভিনয় করেছিলেন। জাগো নিউজ : আপনার দীর্ঘ কর্মজীবন। সংক্ষেপে সেই জীবনের একটা ফ্ল্যাশব্যাক আমাদের সঙ্গে শেয়ার করবেন?এস এম মহসীন : মুক্তিযুদ্ধের পরে আমি রেডিওতে স্টাফ আর্টিস্ট প্রায় এক বছর কাজ করি। এরপর দিল্লিতে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা স্কুলে পড়তে গিয়েছি। উপমহাদেশের অনেক বিখ্যাত শিল্পীই এখানে পড়েছেন। আমাদের সঙ্গে পড়তেন পঙ্কজ কাপুর। দেশে ফিরে এসে শিল্পকলা একাডেমিতে পরিচালক হিসেবে চাকরি করেছি প্রায় ২৪ বছর। মাঝে কয়েক বছর ডিজির দায়িত্বও পালন করেছি। শিল্পকলার নাট্যশালাটি আমার হাতেই গড়া। পাশাপাশি জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২০ বছর পড়িয়েছি। আমার অনেক ছাত্রছাত্রীরা এখন ভালো নাটক করে। এটা আমাকে তৃপ্তি দেয়।

Advertisement

জাগো নিউজ : আপনি তো টেলিভিশনে নাটকে ও সিনেমাতেও অভিনয় করেছেন। এই মূহুর্তে আপনার প্রিয় কোন কাজের কথা মনে পড়ছে?এস এম মহসীন : অনেক নাটকে অভিনয় করেছি। সবই প্রিয়। তার মধ্যে বিশেষভাবে একটা নাটকের কথা মনে পড়ছে। নাম ‘গরম ভাত ও নিছক ভূতের গল্প’। অনিমেষ আইচ নির্মাণ করেছিলেন নাটকটি। এই নাটকে অভিনয় করে অনেক প্রশংসা পেয়েছিলাম। এছাড়া ‘নূরু মিয়া ও তার বিউটি ড্রাইভার’ সিনেমায় খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। এই চরিত্রটির জন্যও অনেক প্রশংসা পেয়েছি।

জাগো নিউজ : একটু আগে বলছিলেন বঙ্গবন্ধুর ছেলে শেখ কামাল ও আপনি এক নাটকে অভিনয় করেছিলেন। সেই নাটক ও সেখানে অভিনয়ের কিছু অভিজ্ঞতা শুনবো.....এস এম মহসীন : বঙ্গবন্ধু আমাকে অত্যন্ত আদর করতেন। সবাই জানে। ১৯৭২ সালে সরকারিভাবে কলকাতায় নাটক করেছিলাম। সেই নাটকে আমার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার আর ছেলের চরিত্রে অভিনয় ছিলেন শেখ কামাল। আরও একটা ইনফর্মেশন বলি। এটা হয় তো অনেকের অজানা। বঙ্গবন্ধুর কন্যা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি একসঙ্গে পড়ালেখা করেছি। প্রধানমন্ত্রী হয় তো জানেন না সেভেন্টি ব্যাচে আমিও ছিলাম বাংলা বিভাগে।

জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কোনো সাক্ষাতের স্মৃতি মনে পড়ে?এস এম মহসীন : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে আমরা চার বন্ধু সর্বশেষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমি, কাজী ফিরোজ রশীদ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট নূর আলম সিদ্দিকী। আমার এখনো সেই দিনের কথা মনে পড়ে। অনেক কষ্টও দেয়।

জাগো নিউজ : আপনি এগুলো নিয়ে তেমন একটা কথা বলেননি আগে!এস এম মহসীন : আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছি। আমি নাটক ভালোবেসেছি। অনেক কাজ করার চেষ্টা করে গেছি, সেগুলো নিয়েও কখনো চিৎকার করে বলিনি। আমি রাজনীতিও করেছি মন দিয়ে। এক সময় ছাত্রলীগ করেছি। পরে যুবলীগের প্রথম কালচারাল সেক্রেটারি ছিলাম ঢাকা মহানগরীর। তবে নিভৃতে থাকতে থাকতেই পছন্দ করেছি সবসময়। তাই রয়ে গেছি। আমার তাতে কোনো আক্ষেপ বা আফসোস নেয়। আমি যা চেয়েছি তা পেয়েছি। অভিনয়ের ধারাবাহিকতা, মানুষ ও দেশের কাছে সম্মান-ভালোবাসা।

Advertisement

আমার অনেক তৃপ্তির জায়গা আছে। বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের উপস্থিতিতে আমি ধারা বর্ণনাও করেছি এক সময়। তখন নিয়মিতই ধারা বর্ণনা করতাম। অনেক অনুষ্ঠানে শুধু ধারা বর্ণনা করার জন্যই আমারই ডাক পড়তো। জীবনে এমন অনেক গল্প আছে যেগুলো বলে শেষ করা যাবে না। এইবার নানাভাবে আমার খোঁজ খবর নিয়ে সরকার আমাকে যে সম্মান দিয়েছে তাতে আমি আবেগে আপ্লুত হয়েছি। অভিভূতও। আমি আবারও কৃতজ্ঞ আমার দেশ ও দেশের সরকারের কাছে।

জাগো নিউজ : চাকরি ও অভিনয় একসঙ্গে করে গেছেন। কোনো সমস্যা হয়নি?এস এম মহসীন : নাটক, অভিনয় নিয়ে থাকতেই ভালো লাগতো। চাকরি হয় তো করতাম না। যদি বাবা না মারা যেতেন। আমি পড়ালেখার জন্য অনেকদিন দেশের বাইরে ছিলাম। পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরলাম ১৯৭৭ সালে তখন আমার বাবা মারা গেছেন। পরিবারের দায়িত্ব নিতে হলো আমাকে। তা না হলে হয়তো অভিনয় নিয়ে আরও ভালো কিছু করতে পারতাম।

জাগো নিউজ : জীবন থেকে পাওয়া আপনার কোনো উপলব্ধির কথা শুনতে চাই.....এস এম মহসীন : মন দিয়ে কাজ করে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। আর সবসময় বিনয়ী হতে হবে আমাদের। যদিও আমাদের দেশে বিনয়টাকে মানুষ নম্রতা ভাবে না, দুর্বলতা ভাবে। তবুও সেসব নিয়ে না ভেবে সবসময় পজেটিভ চিন্তা করতে হবে বেশি বেশি।

জাগো নিউজ : সব শেষে আপনার পরিবার নিয়ে জানতে চাই।এস এম মহসীন : ব্যক্তি জীবনে আমার দুই ছেলে ও স্ত্রী আছেন। দুই ছেলেরই বিয়ে দিয়েছি। সব মিলিয়ে আমি আমার এই জীবন নিয়ে অনেক সুখী। অভিনয় করে দর্শকের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। রাষ্ট্রও আমাকে অনেক বড় সম্মান দিলো। বাকি জীবনটা অভিনয়ের সঙ্গে পার করতে চাই। আরও অনেক ভালো অভিনয় করতে চাই। অনেক ভালো কিছু উপহার দিতে চাই।

এমএবি/এলএ/এমএস