সংগীত শিল্পী ঝ্যাং ইয়ারুর দাদি কোমায় থেকে গত সোমবার না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। হাসপাতালে ভর্তির জন্য গেলেও বারবার তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। জন চেন একজন স্নাতক শিক্ষার্থী। তার মায়ের জন্য সহায়তা পেতে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়েছেন। তার মায়ের প্রচণ্ড জ্বর। ভাইরাসের পরীক্ষার জন্য উহানের হাসপাতালের সামনে রোগীদের দীর্ঘ সারিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার মতো শক্তি তার নেই।
Advertisement
শত শত রোগীর সারির সামনে ৩০ বছর বয়সী এক ক্লান্ত-বিধ্বস্ত চিকিৎসক বসে আছেন। গত দুই সপ্তাহে মাত্র কয়েক ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছেন তিনি। চীনের হুবেই প্রদেশে প্রতিদিন এমন বিশৃঙ্খলা ও হতাশার হাজারও দৃশ্য দেখা যাচ্ছে।
৬ কোটি মানুষের স্থলবেষ্টিত হুবেই প্রদেশে গত বছরের ডিসেম্বরে নতুন করোনাভাইরাস ২০১৯-এনকভ প্রথমবারের মতো শনাক্ত করা হয়। তখন থেকে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে চীনের গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়েছে বিশ্বের অন্তত ২৮টি দেশ ও অঞ্চলে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ৫৬৩ জন নিহত ও ২৮ হাজার মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন।
বিশ্বজুড়ে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লেও ভয়াবহ কোপ পড়েছে হুবেই প্রদেশে। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসে চীনসহ বিশ্বজুড়ে আক্রান্ত এবং প্রাণহানি যত হয়েছে তার ৯৭ শতাংশ হুবেইতে এবং সব রোগীর ৬৭ শতাংশও সেখানকার।
Advertisement
প্রতিদিন এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রাণহানি আগের দিনের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। দ্রুতগতিতে এর প্রকোপ সামলাতে গিয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কিছু দুর্বলতাও প্রকাশ পাচ্ছে; এমনকি মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়াও অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। পুরো বিশ্ব এবং দেশটির অন্যান্য অঞ্চলকে রক্ষায় পুরো একটি শহরকে বলি দেয়ার মতো পথে হেঁটেছে চীন। গত ২৩ জানুয়ারি থেকে অবরুদ্ধ এ শহর এখন বিশ্বের সর্ববৃহৎ কোয়ারেন্টাইন পয়েন্ট।
গাড়ি কারখানা এবং উদীয়মান অর্থনীতির জন্য পরিচিত উহানকে করোনাভাইরাসের মূল্য দিতে হচ্ছে বাসিন্দাদের প্রাণের বিনিময়ে। করোনাভাইরাসে মৃতদের ৩ দশমিক ১ শতাংশ এ শহরের; যখন চীনের অন্যান্য অঞ্চলে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার মাত্র ০ দশমিক ১৬ শতাংশ।
চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের সাবেক মহাপরিচালক ইয়াং গংহুয়ান বলেন, প্রদেশটি বন্ধ করে না দেয়া হলে মেডিক্যাল সহায়তার জন্য দেশের অন্য প্রান্তে লোকজন ছুটে যেতো। আর এর ফলে পুরো দেশকেই মহামারিতে পড়তে হতো।
তিনি বলেন, হুবেই এবং উহানে এই কোয়ারেন্টাইন মানুষের জীবনকে কষ্টের মুখে ফেললেও এটি সঠিক সিদ্ধান্ত। এটা একটি যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াই- কিছুটা কঠিন হলেও এটি অবশ্যই করতে হবে। চীনের দ্বিতীয় একটি শহর উহান। সেখানকার বাসিন্দা এক কোটি ১০ লাখ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চলমান থাকলেও দেশটির মেট্রোপলিটন শহর সাংহাই, বেইজিং অথবা গুয়াংঝুর মতো নয়। উহানে মানসম্পন্ন হাসপাতাল থাকলেও মানবসম্পদের ঘাটতি রয়েছে।
Advertisement
গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নতুন এই করোনাভাইরাস উহানের একটি সামুদ্রিক খাবার বিক্রির বাজার থেকে পশুর মাধ্যমে মানুষের দেহে সংক্রমণ ঘটায়। এর পর মানুষের মধ্যে ব্যাপকহারে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় জানুয়ারির শুরুর দিকে; সেই সময় কর্তৃপক্ষ বড় ধরনের জনসমাগম ঘটে এমন অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়। চীনের নতুন চন্দ্রবর্ষ শুরুর দিন ২৪ জানুয়ারির আগে এটি পুরোপুরি ভয়াবহ আকার ধারণ করে।
উহান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক জেং ইয়ান বলেন, এটা হঠাৎ ভারি বৃষ্টিপাতের মতো হয়ে এসেছিল; যা মুহূর্তেই উহানকে নিরাপত্তাহীন করে তোলে।
এমন নির্মম পরিস্থিতিতে উহানের বাসিন্দারা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। ২৩ বছর বয়সী কলেজ শিক্ষার্থী জন চেন বলেন, শুধুমাত্র করোনাভাইরাসের পরীক্ষার জন্যই মানুষকে গড়ে ৮ ঘণ্টা ধরে হাসপাতালের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তার জ্বরাক্রান্ত মৃতপ্রায় মায়ের পরীক্ষা এখনও করাতে পারেননি।
তিনি বলেন, প্রথমের দিকে হাসপাতালে কর্মী এবং কর্মকর্তাদের কাছে সহায়তা চেয়ে না পেয়ে আমি মুষড়ে পড়েছিলাম। তারা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। কিন্তু পরে আমি বুঝতে পেরেছি যে, এটা এমন নয় যে, তারা সহায়তা করতে চাচ্ছেন না। আসলে সব জায়গায়ই তো জনবলের ঘাটতি রয়েছে।
আমি কাউকে দোষারোপ করতে চাই না। কারণ কেউ যদি চীনে বেড়ে উঠেন তাহলে জানতে পারবেন এখানকার সিস্টেম কীভাবে কাজ করে।
সূত্র : ব্লুমবার্গ।
এসআইএস/পিআর