আন্তর্জাতিক

‘কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার চেয়ে বাড়িতেই মরা ভালো’

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের প্রাণকেন্দ্র চীনের উহান শহরের বাসিন্দা ওয়েনজুন ওয়াং। ৩৩ বছর বয়সী এই নারী একজন গৃহিনী। গত ২৩ জানুয়ারি শহরটিকে অবরুদ্ধ ঘোষণার পর থেকে পরিবারের সদস্যদের-সহ বাড়িতেই আছেন তিনি।

Advertisement

তখন থেকে বুধবার পর্যন্ত চীনে প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ২৪ হাজার ৫৫৮ জন এবং এতে প্রাণ গেছে মোট ৪৯৩ জনের। আক্রান্তদের মধ্যে অন্তত ১৩ শতাংশের (৩২২৩ জন) অবস্থা আশঙ্কাজনক।

কার্যত বিচ্ছিন্ন উহান থেকে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে দেয়া এক স্বাক্ষাৎকারে ওয়াং বেঁচে থাকার জন্য তার পরিবারের হৃদয়বিদারক লড়াইয়ের কথা জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরুর পর এতে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে আমার চাচা মারা গেছেন। আমার বাবার অবস্থা আশঙ্কাজনক। আমার মা এবং চাচীর শরীরেও এই ভাইরাসের কিছু আলামত দেখা দিয়েছে। সিটি স্ক্যানে দেখা গেছে, তাদের ফুসফুসে সংক্রমণ ঘটেছে। আমার ভাইয়ের প্রচুর সর্দি-কাশি এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে।’

Advertisement

ওয়াং বলেন, ‘আমার বাবার প্রচণ্ড জ্বর। গতকাল তার শরীরের তাপমাত্রা ছিল ১০২ ডিগ্রি (৩৯.৩ সেলসিয়াস) ফারেনহাইট। তার ক্রমাগত কাশি এবং শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। আমরা বাড়িতেই তাকে অক্সিজেন দিয়েছি। সপ্তাহের সাতদিন পুরো ২৪ ঘণ্টাই তিনি এই অক্সিজেন মেশিনের ওপর নির্ভর করে আছেন।’

‘এই মুহূর্তে তিনি চীনা এবং পশ্চিমা বিশ্বের ওষুধ সেবন করছেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মতো সরঞ্জাম না থাকায় তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিনা তা এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেজন্য তাকে হাসপাতালে নেয়া সম্ভব হয়নি। নিজেদের স্বাস্থ্যের অবনতি হলেও আমার মা এবং চাচী প্রত্যেকদিন হাসপাতালে গিয়ে শয্যা খুঁজে আসেন। তাদের আশা একটি বিছানা পেলে আমার বাবাকে সেখানে ভর্তি করানো যাবে।’

‘কেউ আমাদের সহায়তা করছে না’

উহানে এখন অনেক কোয়ারেন্টাইন পয়েন্ট স্থাপন করা হয়েছে। যাদের হালকা লক্ষণ পাওয়া গেছে অথবা এখনও ইনকিউবেশনে রয়েছেন; তাদের সেসব কোয়ারেন্টাইন পয়েন্টে রাখা হচ্ছে। সেখানে কিছু সাধারণ স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে; যাতে হালকা চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু আমার বাবার মতো যাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক; সেখানে তাদের জন্য কোনও শয্যা নেই।

Advertisement

ওয়াং বলেন, ‘এ ধরনের একটি কোয়ারেন্টাইন পয়েন্টে আমার চাচা মারা গেছেন। সেখানে মারাত্মক লক্ষণ নিয়ে যারা ভর্তি হয়েছেন, তাদের জন্য পর্যাপ্ত মেডিক্যাল সুবিধা নেই। আমি আশা করছি, আমার বাবা যেন যথাযথ চিকিৎসা পান। কিন্তু এই মুহূর্তে কেউই আমাদের সহায়তা করছে না বা সহায়তার জন্য এগিয়ে আসছে না।’

তিনি বলেন, আমি বেশ কয়েকবার কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমি যে জবাব পেয়েছি সেটা হলো- হাসপাতালে শয্যা পাওয়ার কোনও সুযোগ আমাদের নেই। আমা বাবা এবং চাচা শুরুতেই একটি হাসপাতালে কোয়ারেন্টাইনে গিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে সেটি আর হাসপাতাল নেই। এখন সেটি হোটেলে পরিণত হয়েছে।

‘সেখানে কোনও নার্স অথবা চিকিৎসক নেই এবং কোনও হিটারও নেই। আমার বাবা এবং চাচা সেখানে সকালে গিয়েছিলেন; কিন্তু সেখানকার কর্মীরা তাদের ঠান্ডা খাবার দিয়েছেন সন্ধ্যায়। আমার চাচা সেই সময় খুবই অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। শ্বাস-প্রশ্বাসের গুরুতর সমস্যা দেখা দেয় এবং তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন।’

ওয়াং বলেন, কোনও চিকিৎসক তার চিকিৎসায় এগিয়ে আসেননি। তাকে এবং আমার বাবাকে পৃথক কক্ষে রাখা হয়। বাবা পরদিন সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে আমার চাচার কক্ষে যান। সেখানে গিয়ে তাকে মৃত অবস্থায় পান।

কোয়ারেন্টাইনে যাওয়ার চেয়ে বাড়িতেই মরবো

ওয়াং বলেন, ‘ওই সময় যারা অন্যান্য হাসপাতালে ছিলেন; তাদের জন্য নতুন হাসপাতাল তৈরি করা হয়েছে। এখন তাদেরকেই নতুন হাসপাতালে স্থানান্তর করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মতো মানুষ যারা আছে; আমরা যারা এখনও একটি শয্যা পাইনি, নতুন হাসপাতালেও তাদের ঠাঁই হচ্ছে না।’

‘সরকারের নির্দেশ মানলে আমাদের একমাত্র ঠাঁই হবে কোয়ারেন্টাইন পয়েন্টে। কিন্তু আমরা যদি সেখানে যাই, তাহলে আমার চাচার সঙ্গে যা ঘটেছে; সেটাই আমার বাবার সঙ্গেও ঘটবে। তারচেয়ে বরং আমরা বাড়িতেই মরবো।’

সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা প্রচুর

চারপাশে আমাদের পরিবারের মতো অনেক পরিবার আছে; যারা একই ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি। আমার বাবার বন্ধুর প্রচণ্ড জ্বর ছিল; যে কারণে তাকে কোয়ারেন্টাইন পয়েন্টের কর্মীরা সেখানে জায়গা দেয়নি। আক্রান্ত মানুষের তুলনায় ব্যবস্থাপনা একেবারেই অপ্রতুল। আমরা আতঙ্কিত। এরপর আমাদের সঙ্গে কী ঘটবে তা জানি না।

বিশ্বের কাছে ওয়াংয়ের বার্তা

‘আমি যেটা বলতে চাই, সেটা হলো- আমি যদি জানতাম যে কর্তৃপক্ষ ২৩ জানুয়ারি উহানকে অবরুদ্ধ ঘোষণা করতে যাচ্ছে; তাহলে আমি নিশ্চিতভাবেই আমার পুরো পরিবারকে শহরের বাইরে নিয়ে যেতাম। কারণ এখানে কোনও সহায়তা নেই।’

আমার যদি অন্য কোথাও যেতে পারতাম, তাহলে সেখানে কিছুটা হলেও আশা থাকতো। আমাদের মতো সরকারের নির্দেশ অন্য যারা শুনেছেন এবং উহানে অবস্থান করছেন; তারা সঠিক নাকি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা আমি জানি না। কিন্তু আমার বিশ্বাস এসব প্রশ্নের জবাব আমার চাচার মৃত্যু দিয়েছে।

সূত্র : বিবিসি।

এসআইএস/এমকেএইচ