‘হায় ওরে মানবহৃদয়/বার বার/কারো পানে ফিরে চাহিবার/নাই যে সময়, নাই নাই।/জীবনের খর স্রোতে ভাসিছ সদাই/ভুবনের ঘাটে ঘাটে--/এক হাটে লও বোঝা, শূন্য করে দাও অন্য হাটে।’ -কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের শাহজাহান কবিতাটি আবৃত্তি করছিলেন সাবেক মন্ত্রী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর এমপি। উপস্থিত সুধীজনরা তন্ময় হয়ে শুনছিলেন। কবিগুরুর লেখা, আসাদুজ্জামান নূরের ভরাট কণ্ঠ আর যার জন্য এ আয়োজন সেই ব্যক্তির আজীবনের কীর্তিগাথা, স্মৃতি... সব যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায় সকলের।
Advertisement
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্মরণসভার শুরুটা হয় এভাবেই, তার প্রিয় কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে। মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরায় এ স্মরণসভার আয়োজন করে ব্র্যাক। স্মরণসভায় দেশ-বিদেশের সমাজচিন্তক, মন্ত্রী, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, উন্নয়নকর্মী, শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, গবেষক, গণমাধ্যমব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতিসেবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন। স্মরণসভা শেষে ব্র্যাক গ্লোবাল বোর্ডের চেয়ারপারসন আমিরা হক জানান, টানা পঞ্চমবারের মতো বিশ্বসেরা এনজিও’র স্বীকৃতি পেয়েছে ব্র্যাক।
সুধীজনরা স্যার ফজলে হাসান আবেদের স্মৃতিচারণ করে বলেন, স্যার ফজলে হাসান আবেদ তার বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে শুধু ব্র্যাকের মতো একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানই গড়ে তোলেননি, বরং বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের জীবনমান পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছেন। ব্র্যাক কিংবা বৃহত্তর উন্নয়ন অঙ্গনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই অসংখ্য নেতৃত্ব তৈরি করেছেন তিনি। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর উন্নয়নই তার জীবনের ব্রত ছিল।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশি ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের শিক্ষক ড. মার্থা চেন।
Advertisement
সভায় জাতিসংঘের মহাসচিবের পাঠানো বিবৃতি পড়ে শোনান জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক ও ইউএনডিপির আবাসিক প্রতিনিধি মিয়া সেপ্পো। স্যার ফজলের পরিবারের পক্ষে বক্তব্য রাখেন তার মেয়ে তামারা আবেদ ও ছেলে শামেরান আবেদ।
এছাড়া অনুষ্ঠানে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান, সাবেক পরররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রবার্ট আর্ল মিলার, অস্ট্রিলিয়ান হাই কমিশনের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স পেনি মর্টন, ডিএফআইডির বাংলাদেশ প্রধান জুডিথ হার্বার্টসন, বিশিষ্ট আইনবিদ ড. কামাল হোসেন, বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ড. মঈন খান, অধ্যাপক মো. ইব্রাহিম, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ড. আইনুন নিশাত, নিজেরা করির নির্বাহী পরিচালক খুশি কবির, যাদুশিল্পী জুয়েল আইচ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করা এনজিওগুলোর একটি মোর্চা গঠনকল্পে স্যার ফজলে গণস্বাক্ষরতা অভিযান গঠন করেছিলেন। আজ ২৩২টি এনজিও এর সদস্য। এর পাশাপাশি দারিদ্র্য বিমোচন, নারীর ক্ষমতায়ন প্রভৃতি ক্ষেত্রেও তিনি উন্নয়নকর্মীদের কাছে ছিলেন বটবৃক্ষের মতো। আমরা তার চিন্তা-চেতনা ও আদর্শ বাস্তবায়নে কাজ করে যাব।
ড. ইউনূস বলেন, বিশ্বজুড়ে এনজিও সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকেই পাল্টে দিয়েছিল আবেদ। তার হাত ধরেই এনজিও এক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। তাই আলোচনাসভা বা কয়েকটি বই প্রকাশ করেই আবেদকে স্পর্শ করা যাবে না। বিশেষ করে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আবেদের স্বপ্ন ও চিন্তা-ভাবনাকে ধরার চেষ্টা করতে হবে।
Advertisement
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমাদের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অনেক জনসেবামূলক কাজে আবেদ ভাই অকুণ্ঠচিত্তে সহায়তা করেছেন। আমরা একটি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সেন্টার গড়ে তুলতে যাচ্ছি, যাতে বছরে ১ হাজার ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব হবে। সেই সেন্টারটির নাম আমরা রাখতে চাই স্যার ফজলে হাসান আবেদের নামে।
শামেরান আবেদ বলেন, আমার বাবা এমন এক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন, যেখানে গাড়িচালক-অফিস সহকারী থেকে কর্মকর্তা পর্যন্ত যে কারো সমস্যার কথাই তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তার দরজা ছিল সবার জন্যই উন্মুক্ত।
স্মরণসভা অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে স্যার ফজলে হাসান আবেদকে নিয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। তার প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান অদিতি মোহসিন এবং শামা রহমান।
আরএস/পিআর