১ ফেব্রুয়ারি(২০২০) ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন পরিচালনায় ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। ২০১৮-এর ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত হওয়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অন্তত এক’শ আসনে ‘ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন’(ইভিএম) ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তখন বিষয়টির পক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। পক্ষান্তরে ইভিএম ব্যবহারকে দূরভিসন্ধিমূলক বলেছিল বিএনপি নেতৃবৃন্দ। অন্যদিকে মিডিয়াতে বিষয়টি নিয়ে বিচিত্র তর্ক-বিতর্ক জমে ওঠে। বিশেষত ২০১৮ এর অক্টোবর মাসে তফসিল ঘোষণার আগে ইভিএম নিয়ে তোড়জোড়ের দরকার আছে কিনা, কিংবা বলা হয়েছিল বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহারের প্রস্তুতি বা সামর্থ্য নেই ইসির। ইভিএম ব্যবহার করতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) সংশোধন লাগবে প্রভৃতি।
Advertisement
যাহোক ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাদের যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে ইভিএম ব্যবহারে সফল হয়েছে। ২০১৮ সালেই ৩ হাজার ৮২৯ কোটি টাকায় দেড় লাখ ইভিএম কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যদিও সেসময় ৩০০ আসনে দরকার ছিল ২ লাখ ৬৪ হাজার ইভিএম যেখানে ভোটকক্ষ ধরা হয়েছিল ২ লাখ ২০ হাজার। তবে ১৫০ আসনে দরকার ছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ইভিএম। আর ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি মিলিয়ে প্রায় ২ হাজার ৬০০ কেন্দ্রে ১৪ হাজার ৬০০ বা তার বেশি ভোটকক্ষ ছিল। দুই সিটির নির্বাচনে ৩৫ হাজারের মতো ইভিএম ব্যবহৃত হয়েছে। কারিগরি সহায়তা দিতে প্রতিটি কেন্দ্রে সশস্ত্র বাহিনীর দুজন করে সদস্য মোতায়েন ছিল এবং ২৮ জানুয়ারি চূড়ান্ত মক ভোটিং অনুষ্ঠিত হয়।
দুই.২০১৭ সালের জুলাইয়ে ঘোষিত ইসির কর্মপরিকল্পনার কথা স্মরণ রেখে বলা যায়, জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করার পরিকল্পনাকে আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখতে চাই। মনে রাখতে হবে বর্তমান সরকারের আমলেই বাংলাদেশে ২০১০ সাল থেকে বিভিন্ন নির্বাচনে নির্দিষ্ট কিছু কেন্দ্রে ব্যবহারের মাধ্যমে এই ইভিএম নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। সর্বশেষ গাজীপুর, বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার করেছে নির্বাচন কমিশন। যেমন, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪টি ওয়ার্ডের ১১টি কেন্দ্রের ৭৮টি বুথে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। তারও আগে চট্টগ্রামের সিটি করপোরেশনের ১৪টি কেন্দ্রে ও নারায়ণগঞ্জের সিটি কপোরেশনের ৫৮টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছিল। ৫ জানুয়ারি, ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত কুমিল্লার সিটি কপোরেশনের বেশ কিছু কেন্দ্রে প্রথমবারের মতো ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করা হয়। তবে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের দ্বিতীয়বারের পুরো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহারের মাধ্যমে। এটি ছিল ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তি ব্যবহারের ইতিহাস।
লক্ষণীয় উল্লিখিত নির্বাচনগুলোতে ইভিএম কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন বলে দিয়েছিল আধুনিক এ প্রযুক্তিতে ভোট দিতে আগ্রহের কমতি নেই তাদের। তরুণ ও মধ্যবয়স্ক ভোটাররাই বেশি স্বাচ্ছন্দে ভোট দিয়েছেন ইভিএমে। ইভিএমে নিজের উৎসাহ নিয়েই ভোট দিয়েছেন ভোটাররা। ভোটারদের অভিমত হলো, ইভিএম ব্যবহার করে খুব সহজেই অল্প সময়েই অনেকটা নিরাপদেই ভোট দিতে পেরেছেন তারা। কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল এখন সকলের কাছে দিবালোকের মতো উদ্ভাসিত। এভাবে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ভোটারদের অনেকেরই আগ্রহের কথা জানা গেছে এবং এটা ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষিত জনবলও গড়ে তোলা হয়েছে। আসলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও ভোটারদের ইভিএমের ব্যবহার শেখানো এবং জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করে তুললে এটির জনপ্রিয়তা আরো বৃদ্ধি পাবে।
Advertisement
ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি একবিংশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করার জন্য ভোটারদের নিজস্ব মতামত প্রতিফলন করার অন্যতম মাধ্যম। ভোট প্রয়োগে মেশিন বা ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হয় তাই সামগ্রিক প্রক্রিয়াটি ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ‘ইভিএম’ নামে পরিচিত। এর অন্য নাম ‘ই-ভোটিং’। ইলেকট্রনিক প্রক্রিয়ায় এটি একাধারে সঠিকভাবে ভোট প্রয়োগ ও দ্রুততার সঙ্গে ভোট গণনা করতে সক্ষম। এছাড়াও, ভোট গ্রহণে স্বচ্ছতা এবং উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে ক্রমশই সমগ্র বিশ্বে এটি গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। সর্বপ্রথম ১৯৬৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭টি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনে ইভিএম পদ্ধতি অনুসৃত হতে দেখা য্য়া; ক্রমান্বয়ে পাঞ্চ কার্ডের মাধ্যমে ভোট গ্রহণের বিষয়টি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ইভিএম ব্যবহার করে ইতোমধ্যেই ভোট নেওয়া হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে।
এর মধ্যে আছে, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রাজিল, কানাডা, এস্তোনিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইটালি, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, পেরু, রোমানিয়া, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ভেনেজুয়েলা, ফিলিপাইন প্রভৃতি। এসব দেশে ভোট গ্রহণের স্থান হিসেবে ভোট কেন্দ্রেই মূলত ইভিএম ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও ইন্টারনেট, ব্যক্তিগত কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, টেলিফোন ব্যবহার করেও ই-ভোটিং প্রয়োগ করা সম্ভব। নতুনতর অপটিক্যাল স্ক্যান ভোটিং পদ্ধতিতে পাঞ্চ কার্ড, অপটিক্যাল স্ক্যানার ব্যবহৃত হয়। এ পদ্ধতিতে একজন ভোটার ব্যালট পেপারকে চিহ্নিত করে ভোট প্রদান করেন। অন্যদিকে ডিআর ইভিএম (ডাইরেক্ট রেকর্ডিং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোটিং পদ্ধতিতে একটিমাত্র মেশিনের সাহায্যে ভোট সংগ্রহ ও গণনা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ব্রাজিল এবং ভারতে সকল ভোটার সকল ধরনের নির্বাচনে এটি ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়াও ভেনেজুয়েলা এবং যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে ডিআরই ভোটিং পদ্ধতির প্রচলন রয়েছে।
তিন.বিএনপি’র অভিযোগ সত্ত্বেও বলতে হয়, ইভিএম পদ্ধতি ব্যবহারে কারচুপির কোনো সুযোগ ছিল না। কারণ এটি অপারেট করার জন্য প্রিজাইডিং বা সহকারী প্রিজাইডিং অফিসারের বায়োমেট্রিক্স নেয়া থাকে, তাই তারা ছাড়া কেউ অপারেট করতে পারেনি। কোনো কারণে মেশিন নষ্ট হলেও গৃহীত ভোট নষ্ট হয়নি। মেশিনের কার্ডে শুধু ওই কেন্দ্রের ভোটারদের তথ্য থাকে ফলে অন্য কেউ ভোট দিতে পারেনি। আবার কেউ কারও ভোট মুছেও দিতে পারেনি। কেউ একাধিকবার বাটন চাপলেও প্রথমে যেখানে ভোট দিয়েছেন সেটিই থেকেছে। আবার মেশিনটিতে ব্যবহারের জন্য স্মার্ট কার্ড থাকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে, ফলে অন্য কেউ বুথ কক্ষ দখল করলেও কোনো কাজে আসেনি।
অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময় শেষে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কন্ট্রোল ইউনিট থেকে ক্লোজ সুইচ চাপলে ভোট দেয়ার আর কোনো সুযোগ থাকে না। ইভিএম কোনোভাবেই ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, তাই হ্যাক করা যায় না, যে কেন্দ্রের ইভিএম তা দিয়ে সেই কেন্দ্রেই ভোট দেয়া যায়। ভোটার যখন ভোট দিতে এসেছেন তখন স্মার্ট কার্ড বা পরিচয়পত্র নম্বর বা ফিঙ্গার প্রিন্টার দিয়ে যাচাই করে তাকে ভোট দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এর কোনো একটি দিয়ে যাচাইয়ের পর ভোটারের ছবি প্রজেক্টরে দেখা গেছে যেটা সব প্রার্থীর এজেন্টরাও দেখতে পেয়েছেন এবং এরপর তিনি ভোটদানের গোপন কক্ষে প্রবেশের সুযোগ পান।
Advertisement
বৈধ ভোটার সনাক্ত হওয়ার পর ভোটার গোপন কক্ষে উপস্থিত হন যেটি ব্যালট ইউনিট হিসেবে পরিচিত। সেখানে ঢুকেই তিনি ব্যালট পেপার দেখতে পান মেশিনে এবং প্রতীকের পাশে থাকা বাটন চাপ দিয়ে ভোট দেন। ভোট দেয়ার পর স্ক্রিনে যাকে ভোট দিয়েছেন সেই প্রার্থীর প্রতীকের ছবি ভেসে উঠেছে। এটিই ভোটারের জন্য কনফার্মেশন যে তিনি কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন। ভোটার কনফার্ম করার বাটনে চাপ দিলে একটি শব্দ আসে যাতে বোঝা যায় যে তার ভোট দেয়া হয়ে গেছে। ইভিএম-এর পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ এবং সুবিধাজনক।
চার.সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে আমরা দেখতে পাই- প্রদর্শন, ভোটিং শিক্ষা ও জনসচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে নির্বাচন কর্মকর্তারা কিছু দিন কাজ করায় ভোটাররা ইভিএম-এ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। প্রতিটি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার বাইরে অন্তত তিনজন করে কারিগরি কর্মকর্তা রাখা ছিল। কারিগরি ত্রুটির কারণে ভোট গ্রহণে যেন সমস্যা না হয়; ভোটার যেন স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। আসলে ইসি’র সক্ষমতাই ইভিএম’কে গ্রহণযোগ্যতা প্রদান করেছে। নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল এবং দ্রুত ফল ঘোষণার জন্য ইভিএম পদ্ধতির কোনো বিকল্প নেই। আগামী স্থানীয় কিংবা জাতীয় যে কোনো নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত অবশ্যই ইতিবাচক ও প্রশংসনীয় বলে গণ্য হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
এইচআর/জেআইএম