ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমার কৌতূহল ছিল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম নিয়ে। নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার আগেও হয়েছে। তবে ঢাকার দুই সিটি মানে রাজধানীজুড়ে ইভিএমের ব্যবহার এই প্রথম। আমার কৌতূহল ছিল, মানুষ কীভাবে ইভিএমকে গ্রহণ করে। নীতিগতভাবে আমি ইভিএমের পক্ষের লোক ছিলাম। আমি বিশ্বাস করি যুগের সাথে তাল মেলাতে আমাদের প্রযুক্তির কাছেই যেতে হবে। কিন্তু কাছ থেকে ইভিএম দেখার পর আমার সেই বিশ্বাস চলে গেছে। হ্যাং হয়ে যাওয়ায় অনেক জায়গায় ভোট শুরু হতে দেরি হয়েছে বা বিঘ্নিত হয়েছে। সব জায়গায় ভোট দেয়ার গতি ছিল মন্থর। ব্যালটে ভোট দিতে যেখানে মিনিটখানেক লাগত, ইভিএমে লাগছে তিন থেকে পাঁচ মিনিট। সেটাকে না হয় আমাদের মানে ভোটারদের অনভিজ্ঞতা হিসেবে ধরে নিলাম। কিন্তু আঙুলের ছাপ না মেলায় অনেককে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। সেই তালিকায় আছেন সিইসি নুরুল হুদা, ড. কামাল হোসেনের মতো লোকও।
Advertisement
আমার কৌতূহল ছিল, ইভিএমে কীভাবে কারচুপি করা যাবে? চুরি-চামারি না করে ইভিএমে সরাসরি ডাকাতি করা হয়েছে। গোপন ভোট, গোপন কক্ষের ধারণাগুলোই যেন উঠে গেছে এবার। সরকারি দলের বন্ধুদের অনেকে এতটাই ভালো, তারা সার্বক্ষণিকভাবে ভোটারের পাশে ছিলেন, এমনকি গোপন কক্ষেও তাকে একা যেতে দেননি। ইভিএমে পছন্দের প্রার্থীর বাটনে চাপ দেয়ার কষ্টটাও ভোটারকে করতে হয়নি। একজন ভোটার আঙুলে অমোচনীয় কালির ছাপ লাগিয়েছেন, আঙুলের ছাপ মিলিয়ে ব্যালট ওপেন করেছেন; কিন্তু পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেননি। আওয়ামী লীগের দরদী বন্ধুরা এসে বাটনটি চাপ দিয়ে দিয়েছেন। তারা ভোটারদের ভুল করতে দিতে চাননি। ভুল করে যদি ভুল বাটনে চাপ পড়ে যায়।
এবার সিটি নির্বাচনে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারদের জন্য হাহাকার ছিল। সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকদের দেখানোর জন্য ভুয়া লাইন বানাতে হয়েছে। তবে এবার যা হয়েছে তাতে ভোটের প্রতি ভোটারদের আগ্রহ আরও কমে যাবে। এবার জমজমাট নির্বাচনী প্রচারণা দেখে আমি খুব আশাবাদী হয়েছিলাম, যাক আবার বুঝি বাংলাদেশে নির্বাচনী উত্তাপ ফিরে এলো। ভোট, নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা বুঝি এবার ফিরবে। কিন্তু আমার সে আশার গুড়েবালি ঢেলে দিল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। নির্বাচন হলো একটি খেলার মতো। প্রচারণার ২০ দিনের সময়টায় বিএনপি আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানে সমানে লড়াই করল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে বিএনপি ফাইনালের দিনে ওয়াকওভার দিয়ে দিয়েছে। সাধারণ ভোটারদের তো বিএনপি কেন্দ্র পর্যন্ত আনতে পারেইনি, কর্মীদেরও পারেনি।
প্রচারণার সময় ইশরাক আর তাবিথের মিছিলে যারা ছিল, যারা দিনের পর দিন কাজ করল; তাদের সবাইও কেন্দ্রে আসেনি। নির্বাচনে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল এজেন্ট নিয়ে। অনেক কেন্দ্রেই বিএনপির এজেন্ট ছিল না। কোথাও কোথাও এজেন্টদের মেরে বের করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ কেন্দ্রে এজেন্ট যানইনি। হয়তো একদিনের হিরো সাজতে গিয়ে সারা বছরের ভোগান্তি ইনভাইট করতে চাননি অনেকে। হয়তো অনেকে কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ কর্মীদের মহড়া দেখে ভয়ে আর যাননি। অবশ্য কেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগের মহড়া দেখে শুধু বিএনপির এজেন্ট নয়, সাধারণ ভোটাররাও ভয় পেয়েছে। কারণ ভয় দেখাতেই চেয়েছে। এভাবে একটা নির্বাচনী বৈতরণী হয়তো পার হওয়া যাবে, কিন্তু আওয়ামী লীগকে জনগণের কাছ থেকে আরও দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।
Advertisement
বিএনপির ওয়াকওভারে ফাঁকা মাঠ পেয়ে আয়েশ করে গোল দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু ফাঁকা মাঠে গোল দিতেও ফাউল প্লে করতে ছাড়েনি আওয়ামী লীগ কর্মীরা। কেন্দ্রের সামনে মহড়া থেকে শুরু করে গোপন বুথ পর্যন্ত ফলো করা, বাটন টিপে দেয়া- সব মিলিয়ে একতরফা খেলায় ফাঁকা মাঠেও ফাউল হয়েছে।
তবে ইভিএমের সব খারাপ নয়। নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার অন্তত দুটি অর্জন পেয়েছেন- আগের রাতে ভোট না পড়া এবং কোনো কেন্দ্রে শতভাগ ভোট না পড়া। তারমানে তিনি বলতে চাইছেন অতীতে আগের রাতে ভোট হয়েছে এবং শতভাগ কাস্ট হয়েছে। সত্যি এবার সেটা হয়নি। আর হয়নি বলেই ভোটারের জন্য এত হাহাকার। এখন আর মতো সিল মেরে বাক্স ভরে ফেলা সম্ভব নয়। এখন কারচুপি করতে হলেও আঙুল মানে ভোটার লাগবে। এ কারণেই এবার ভোট পড়েছে ৩০ ভাগের কম। আর সেটা আগের মতো বাড়িয়েও দেখানো যায়নি। ইভিএমে আর কিছু না হোক, ভেবেছিলাম তাড়াতাড়ি ফলাফল পাওয়া যাবে। সেটাও হলো না। সেই যদি ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে, তাহলে আর ইভিএম করে লাভ কী?
বলছিলাম ভোটারদের কথা। ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে না পারা অনেকেই এবার কেন্দ্রে যাননি। যারা গিয়েছেন, তাদের অনেকের অভিজ্ঞতা তাকে তো বটেই, আরও অনেককেই কেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করবে। এমন অনেককে চিনি যারা আওয়ামী লীগের শুভাকাঙ্ক্ষী, কেন্দ্রে গিয়েছেন নৌকায় ভোট দিতে। কিন্তু দিতে পারেননি। আওয়ামী লীগেরই কেউ হয়তো নৌকাতেই দিয়েছে; কিন্তু ভোটার তো নিজ হাতে পছন্দের প্রার্থীকে ভোটটা দিতে পারেননি। যে অমোচনীয় কালি তার গৌরবের হতে পারত; সেটাই এখন তার জন্য গ্লানির, লজ্জার।
অর্ণব রাফি নামে এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ফেসবুকে তার গোপন বুথে গিয়েও ভোট দিতে না পারার এবং অপমানিত হওয়ার বিবরণ দিয়েছেন। ভাইরাল হওয়া এই ভিডিওতে রাফি বলেছেন, এই দেশেই আর থাকবেন না তিনি। আরেকজন লিখেছেন, ‘আমার ভোট যদি তুই দিবি, তাইলে হাঁটায়ে এত দূর আনলি কেন? বাসায় শান্তিপূর্ণভাবে নিদ্রায় শায়িত আছিলাম।’
Advertisement
হয়তো এমন দিন আসছে, আমাদের কাউকেই আর কেন্দ্রে যেতে হবে না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে নিদ্রায় শায়িত থাকব, গণতন্ত্রও আমাদের পাশেই শান্তিপূর্ণভাবে শায়িত থাকবে। আর আওয়ামী লীগের অতন্দ্রপ্রহরী কর্মীরা আমাদের হয়ে ঠিক জায়গায় ভোট দিয়ে দেবে।
এইচআর/বিএ/পিআর