নিরাপদ, বাসযোগ্য, পরিবেশবান্ধব, মানবিক, স্মার্ট সিটি গড়ার গালভুরি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঢাকার দুই সিটির যে মেয়র প্রার্থীরা, তাদের প্লাস্টিকে মোড়ানো বা লেমিনেটেড পোস্টারেই পুরো রাজধানী ছেয়ে ফেলা হয়েছে। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খোদ হাইকোর্টও। গত ২২ জানুয়ারি হাইকোর্ট এসব পোস্টার বন্ধে নির্দেশনা দিলেও শহরের কোনো জায়গা থেকে এসব পোস্টার সরানো হয়নি। অর্থাৎ আদালতকে তারা থোড়াই কেয়ার করেন।
Advertisement
বিবিসির খবরে বলা হচ্ছে, প্লাস্টিক মোড়ানো পোস্টারের কারণে নির্বাচনি প্রচারণার প্রথম ১২ দিনে প্রায় আড়াইশো টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে। পরিবেশ বিষয়ক বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট এন্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা এসডোর গবেষণার বরাতে ওই খবরে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের ৪৮টি প্রেস এবং প্রার্থীদের নির্বাচনী এজেন্টদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে প্লাস্টিক দূষণের এই ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। প্রধান দুই দলের মেয়র প্রার্থীদের প্রত্যেকে গড়ে ৩০ লাখের বেশি প্লাস্টিকে মোড়ানো পোস্টার টাঙিয়েছেন বলেও ওই সংবাদে উল্লেখ করা হয়।
এখন প্রশ্ন হলো, এই পোস্টারগুলো কোথায় যাবে? ভোটের পরপরই সিটি করপোরেশন কি এগুলোকে ধ্বংস করতে পারবে? বস্তুজগতে যা কিছু জঞ্জাল তৈরি করে, প্লাস্টিক বা পলিথিন তার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতি। মাটি বা পানির ভেতরে থাকলে শত বছরেও এগুলো ধ্বংস হয় না। এর একমাত্র উপায় পুড়িয়ে ফেলা। কিন্তু পলিথিন পোড়ানো হলে যে গ্যাস তৈরি হয়, সেটিও ক্ষতিকর। প্লাস্টিক তৈরিতে যেসব রাসায়নিক উপাদানের ব্যবহার হয়, সেগুলো বিষাক্ত এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।
ফলে এক নির্বাচনে যে আড়াইশো টন বর্জ্য তৈরি হলো, সেটির ব্যবস্থাপনা কী হবে—তা নিয়ে নতুন মেয়ররা কী ভাবছেন তা এখনও পরিষ্কার নয়। তারা এগুলো কীভাবে সরাবেন, কীভাবে ধ্বংস করবেন—তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে সে কথা উল্লেখ নেই। যদিও তারা সবাই পরিবেশ বিষয়কে তাদের ইশতেহারে গুরুত্ব দিয়েছেন। কেউ কেউ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কথাও বলেছেন। অথচ তারা নিজেদের পোস্টারেই টন টন পলিথিন ব্যবহার করে যে স্ববিরোধিতার নজির সৃষ্টি করেছেন, তা নজিরবিহীন।
Advertisement
অতীত অভিজ্ঞতা বলে, ভোটের পরে এই পোস্টারগুলো মানুষ ছিঁড়ে ফেলবে। বিজয়ী প্রার্থীর লোকেরা প্রতিপক্ষের পোস্টার টেনেহিঁচড়ে নামাবে। দেয়াল থেকে উঠিয়ে ফেলবে এবং সেগুলো প্রথমে ফেলা হবে রাস্তায়। সেই পোস্টার মানুষের পায়ে পায়ে এবং যানবাহনের চাকায় গড়িয়ে পড়বে ড্রেন ও নর্দমায়। এরকম হাজার হাজার পোস্টারে আটকে যাবে ড্রেনের মুখ যার ভয়াবহ পরিণতি দেখা যাবে আগামী বর্ষায়। পানির তোড়ে এবং সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বদৌলতে এসব পোস্টারের পরবর্তী গন্তব্য হবে বুগিড়ঙ্গা নদী—যে নদী একসময় প্রায় ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছিল। যে নদীর তলদেশে এখনও পলিথিনের বিশাল স্তর। এখন প্রশ্ন হলো, যে রাজনীতিবিদরা পরিচ্ছিন্ন আর আধুনিক ঢাকা গড়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন, তারা কোন আক্কেলে পলিথিনের মতো একটা ভয়াবহ পরিবেশবিধ্বংসী উপাদান দিয়ে তাদের হাজার হাজার বা লাখ লাখ পোস্টারে পুরো নগরী ছেয়ে ফেললেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন, খোদ হাইকোর্টের নির্দেশনার পরও এই পোস্টারগুলো কী করে দেয়ালে এবং মাথার উপরে ঝুললো?
হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার ছাপা, লাগানো ও প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে। নির্বাচন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে লেমিনেটেড পোস্টার ছাপা এবং প্রদর্শন বন্ধে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তাও জানতে চেয়ে আদালত রুল জারি করেন। নির্বাচন কমিশন, নির্বাচন কমিশনের সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সচিব, শিল্প সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, দুই সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের ৪ সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা হাইকোর্টকে কী জবাব দেবেন এবং লেমিনেটেড পোস্টার অপসারণে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন, সেটিও জাতির জানা প্রয়োজন। কারণ তারা যে কোনো ব্যবস্থা নেননি, তার প্রমাণ ভোটের দিন পর্যন্ত সারা শহরে এই পলিথিনে মোড়ানো পোস্টার চোখে পড়েছে।
প্রসঙ্গত, দেশে পোস্টার নিয়ন্ত্রণ আইন আছে। পরিহাস হলো, যাদের জন্য এই আইন, তাদের অধিকাংশই এই আইন সম্পর্কে জানেন না। আইনটি পাস হওয়ার ৮ বছর পরেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও এ আইনটি সম্পর্কে কোনো সচেতনতা আছে বলে মনে হয় না। নবম সংসদে ২০১২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বিলটি পাশ হয়।
বাসাবাড়ি ও অফিসের দেয়াল, বিদ্যুতের খুঁটি, ঐতিহাসিক স্থাপনা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমনকি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দেয়ালও এই পোস্টারসন্ত্রাসের হাত থেকে মুক্তি পায় না। রাজধানীর যেসব এলাকায় কোচিং সেন্টার বেশি, যেমন রাজধানীর ফার্মগেট, সেসব এলাকায় ব্যাচেলরদের জন্য ঘর ভাড়া এবং কোচিং সেন্টারের পোস্টার ও ব্যানার যে কতটা অনিয়ন্ত্রিত হতে পারে, তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে এসব পোস্টার ও ব্যানার সাঁটানো হয়, সেসব উদ্দেশ্য বা কাজ শেষ হয়ে গেলেও পোস্টার ও ব্যানার সরানো হয় না। বছরের পর বছর সেগুলো দেয়ালে থাকে। আবার সুকান্তের ‘এসেছে নতুন শিশুর মতো’ পুরনো পোস্টারের উপরে সাঁটা হয় নতুন পোস্টার।
Advertisement
আইন কী বলছে? ‘নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে না। এই আদেশের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, কোন স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগাইবার জন্য প্রশাসনিক আদেশ দ্বারা স্থান নির্ধারণ করিয়া দিতে পারিবে এবং উক্তরূপে নির্ধারিত স্থানে দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে। তবে শর্ত থাকে যে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে, উল্লিখিত নির্ধারিত স্থান ব্যতীত অন্য কোন স্থানে বিধি দ্বারা নির্ধারিত শর্ত ও পদ্ধতিতে এবং নির্দিষ্ট ফি প্রদান সাপেক্ষে, দেওয়াল লিখন বা পোস্টার লাগানো যাইবে।’
কিন্তু কেউ যদি আইন লঙ্ঘন করেন? বলা হয়েছে, এই আইনের বিধান লঙ্ঘন করে দেয়াল লিখন ও পোস্টার লাগানোর শাস্তি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কোম্পানির বিরুদ্ধে সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার এবং সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা ১৫ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া যাবে।এই আইন লঙ্ঘন করার অভিযোগ পাওয়া গেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন, ২০০৯ অনুযায়ী বিচার করা হবে। সুবিধাভোগীর ক্ষেত্রে অভিযোগ পাওয়া গেলে ফৌজদারি বিধি ১৮৯৮ অনুযায়ী সংক্ষিপ্ত পদ্ধতিতে বিচার হবে।
তবে শুধু আইনের ব্যত্যয় নয়, এভাবে বেপরোয়া এবং নিয়ন্ত্রণহীন পোস্টার শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করে; নাগরিকদের মনে বিরক্তির জন্ম দেয় এবং তারও চেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো, পোস্টার লাগিয়েই লোকজন নেতা হয়ে যায় অথবা হতে চায়।
অনিয়ন্ত্রিত পোস্টার ও ব্যানার শহরের দৃশ্যদূষণও ঘটায়। আমরা বায়ু ও শব্দ দূষণ নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন বা সরব, এই দৃশ্য দূষণ নিয়ে ততটা নই। এর একটি কারণ হতে পারে এই যে, যেহেতু এসব পোস্টারের অধিকাংশই রাজনৈতিক নেতাদের, এবং আরও পরিস্কার করে বললে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের নেতা ও পাতিনেতাদের পোস্টারেই দেয়াল ছেয়ে যায়, ফলে কার এমন বুকের পাটা যে এসবের বিরুদ্ধে বলবে? তার চেয়ে বরং বায়ু ও শব্দ দূষণ নিয়ে কথা বলা নিরাপদ।
মানুষ যা দেখে অর্থাৎ তার দৃশ্যসীমায় যা কিছু ধরা দেয়, তার বিষয়বস্তু ও রঙ সরাসরি তার মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। যেমন একটি হাস্যোজ্জ্বল শিশুর বড় পোস্টারে চোখ পড়লে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে আপনার অপছন্দের কোনো লোকের বিশাল ছবিসম্বলিত পোস্টার দেখলেই মেজাজ বিগড়ে যাবে। ফলে দেয়ালে পোস্টার টানানোর বিষয়টিও নগরব্যবস্থাপনার অংশ। কিন্তু এ বিষয়ক আইনের ‘কাজীর গরু’ কেতাবে থাকলেও গোয়ালে অনুপস্থিত।
আমীন আল রশীদ : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
/জেআইএম