মধ্যবয়সী ফয়েজ আলী, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে রামপুরার একটি ভোটকেন্দ্রে যান। ভোটার তালিকার সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম ও ছবির মিল থাকলেও আঙুলের ছাপ মেলেনি। একপর্যায়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশেষ ক্ষমতায় তাকে ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করে দেন।
Advertisement
ভোট দেয়ার গোপন কক্ষে গিয়ে এই ভোটার ভোটগ্রহণ কর্মকর্তার উদ্দেশে বলেন- স্যার, কোন আঙুল দিয়ে ভোট দিমু। মাঝের আঙুল দিয়ে বোতাম চাপলে কি ভোট হবে। নাকি বুড়ো আঙুলে চাপতে হবে। এ সময় ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা তাকে বলেন যেকোনো আঙুল দিয়ে আপনি বোতাম চেপে ভোট দিতে পারবেন।
প্রথমবারের মতো ঢাকা সিটি নির্বাচনে ইভিএমে এ ধরনের নানা বিড়ম্বনায় পড়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে সব থেকে বড় অভিযোগ আঙুলের ছাপ না মিলা। বিশেষ করে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এ ধরনের বিড়ম্বনায় পড়ার অভিযোগ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।
তবে পানি দিয়ে হাত দেয়ার পর কারও কারও আঙুলের ছাপের সমস্যার সমাধান হচ্ছে। অবশ্য যাদের আঙুলের ছাপ কোনোভাবেই মিলছে না তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে বিশেষ ব্যবস্থায় ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন ভোট নেয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
Advertisement
আঙুলের ছাপ ছাড়াও ভোটিং মেশিন নষ্ট হয়ে যাওয়া অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। আবার ভোট না দিলেও, ভোট পড়ে গেছে এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।
আঙুলের ছাপ নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়া আরিফুল ইসলাম নামের রামপুরার এক বাসিন্দা বলেন, ভোটের পরিবেশ বেশ ভালো। কিন্তু আঙুলের ছাপ নিয়ে আমাকে একটু বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম ও ছবির সঙ্গে মিল থাকলেও আঙুলের ছাপ মেলেনি। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বিশেষ ব্যবস্থায় ভোট দেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন।
ভোটারদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সালামবাগ জামে মসজিদ ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার নোমান বলেন, বয়স্কদের আঙুলের ছাপ নিয়ে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে আঙুলের ছাপ মিলছে না, এমন ব্যক্তির হাত পানি দিয়ে ধোয়ার পর চাপ মিলেছে এমন ঘটনাও আমার এখানে ঘটেছে।
তিনি বলেন, যাদের আঙুলের ছাপ কোনোভাবেই মিলছে না, তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে বিশেষ ব্যবস্থায় ভোট দেয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
Advertisement
রামপুরার রেডলিফ ইন্টারন্যাশনাল ভোটকেন্দ্রের এক কর্মকর্তা বলেন, কিছু কিছু ভোটারের ক্ষেত্রে আঙুলের ছাপে সমস্যা হচ্ছে। জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে নাম ছবি মিললেও আঙুলের ছাপ মিলছে না। সে ক্ষেত্রে আমরা প্রিসাইডিং অফিসারের অনুমোদন নিয়ে ভোটারের ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করছি। এভাবে আমরা এক শতাংশ পর্যন্ত ভোটারের ভোট দেয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারব।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মাতুয়াইল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে তিনটি ভোট নেয়ার পরেই একটি বুথের ব্যালট ডিভাইসটি নষ্ট হয়ে যায়। এ জন্য নারীদের অনেকেই ভোট দেয়ার জন্য পাঁচ নম্বর কক্ষের সামনে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।
মাতুয়াইল কবরস্থান এলাকা থেকে এসেছেন আরিফা ইয়াসমিন। পাঁচ নম্বর কক্ষের সামনে অপেক্ষা করছিলেন তিনি। ইয়াসমিন বলেন, অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি, ভোট দিতে পারছি না। শুনলাম মেশিন নাকি নষ্ট হয়ে গেছে।
মাতুয়াইল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, একটি বুথের ব্যালট ডিভাইসটি হঠাৎ নষ্ট হয়ে যায়। কর্মকর্তাদের ডাকা হয়েছে তারা মেরামত করছেন।
মাতুয়াইল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট না দিতে পেরে ফিরে যাচ্ছিলেন মাতুয়াইল মাদরাসা রোডের বাসিন্দা রাকিব উদ্দিন। তিনি বলেন, মেশিনে আমার আঙুলের ছাপ নিচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও ভোট দিতে পারেনি। অফিসাররা বলেছে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসতে। হাত ধুয়ে আবার আসব।
শাজাহানপুর মির্জা আব্বাস মহিলা ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে যাওয়া নূর মোহাম্মদ বলেন, আমি যখন ভোট দেব তখন মনিটরে আমার ছবি উঠছে। এরপর আমার আইডি নম্বর দিয়েছি। তারপর আমাকে বুথে পাঠিয়েছে। বুথ থেকে আমি জানতে আসছি ভাই আমার প্রতীকের ছবি আসে না কেন। তখন তারা বলে আপনার ভোট হয়ে গেছে। আমি ভোট দিলাম না, তা হলে আমার ভোট কিভাবে হয়ে গেল?
মিরপুরের মনিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিতে এসে ভোগান্তির মধ্যে পড়েন ৭০ বছর বয়স্ক আক্কাস আলী। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পশ্চিম মনিপুরী পাড়ায় থাকেন তিনি। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। সকাল ৯টায় ভোট দিতে এসে অনেকবার ফিঙ্গার দেয়ার চেষ্টা করলেও তা ইভিএম মেশিন নেয়নি।
তিনি বলেন, মেশিনে আঙুলের ছাপ না নেয়ায় কয়েকবার হাত পানি দিয়ে পরিষ্কার করে আসলেও তাতে কাজ হয়নি। বর্তমানে প্রিসাইডিং অফিসারের কাছে যে অন্য কোনো পদ্ধতিতে ভোট দেয়ার চেষ্টা করবেন বলে জানান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, এ কেন্দ্রে সাতটি বুথে ২ হাজার ৭৬০টি পুরুষ ভোট রয়েছে। সকাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ জনের হাতের ছাপ মেশিনে মেলেনি। তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে ফরম পূরণের মাধ্যমে ভোট নেয়া হচ্ছে।
ইভিএমে ভোট দিতে গিয়ে অনেকের আঙুলের ছাপ না মেলার খবর পেয়েছেন বলে জানান উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবুল কাসেম।
তিনি জানান, এ ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তা নিজের আঙুল দিয়ে এক শতাংশ ভোটারকে চিহ্নিত করে দিতে বা ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারেন। তার কাছে এমন একজন আসার পর তাকে এভাবে ভোট দিতে সহযোগিতা করেছেন বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেন, আঙুলের ছাপ না মিললে ভোট দেয়ার কয়েকটা উপায় রয়েছে। কোনো না কোনো উপায়ে ভোট দিতে পারবেই ভোটাররা। পুরাতন এনআইডি কার্ড ব্যবহার করে, ভোটার নম্বর মিলিয়ে তারা ভোট দিতে পারবে।
আঙুলের ছাপ না মেলা নিয়ে বড় অভিযোগ আসলেও ভোটারদের বেশিরভাগই ইভিএমে ভোট পদ্ধতি নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবি, ইভিএমে ভোট দেয়া সহজ এবং কোনো ঝামেলা নেই।
রামপুরার বাসিন্দা আমজাদ আলী নামের ৬৫ বছরের এক ভোটার বলেন, আগে কখনও ইভিএমে ভোট দেয়নি। তবে ইভিএমে ভোট দেয়া খুব সহজ। আমার কাছে আগের পদ্ধতি থেকে এটাই ভালো মনে হচ্ছে। এ পদ্ধতিতে ভোটে চুরি-চামারি করার সুযোগ নেই।
ফয়েজ আলী নামের ৬৫ বছরের রামপুরার আরেক ভোটার বলেন, আগেরবার সিল মেরে ভোট দিতে গিয়ে এলোমেলো হয়ে গেছিল। এবার ভালো ভাবেই ভোট দিতে পারছি। আমার কাছে আগের থেকে ভোটের পদ্ধতি ভালো মনে হচ্ছে।
রামপুরার কমিশনার প্রার্থী লিয়াকত কমিশনার বলেন, নতুন পদ্ধতিতে প্রথমে একটু সমস্যা হবেই। প্রথম প্রথম যোগ-বিয়োগ করতে গেলেও ভুল হয়। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমার কাছে ভোটের সার্বিক পরিস্থিতি খুব ভালো মনে হচ্ছে।
মো. কাওসার নামে ঢাকা দক্ষিণ সিটির একজন ভোটার বলেন, ইভিএম-এ খুব সহজে ভোট দিতে পারছি। পছন্দের প্রার্থীকে নির্ভয়ে ভোট দিতে পেরেছি। মেশিনের মাধ্যমে ভোট চুরির কোনো পথ নাই। এটা ভালোই লাগছে।
জীবনের প্রথম ভোট ইভিএম মেশিনের মাধ্যমে প্রদান করে আহমদ নগর আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সাদিয়া আফরিন বলেন, খুব সহজেই ইভিএম মেশিনের মাধ্যমে ভোট দিতে পেরেছে। এটি অনেক সহজ ও সময় কম লাগে। আঙুলের ছাপ দিয়ে সব তথ্য পাওয়া গেছে। গোপন কেন্দ্রে গিয়ে ইভিএম মেশিন এর মাধ্যমে নিজের ভোট প্রদান করেছেন।
এমএএস/জেএইচ/এমএস