স্বাস্থ্য

কোটি কোটি মানুষের জীবন কেড়েছে যেসব ভাইরাস-ব্যাকেটেরিয়া

বিশ্বজুড়ে এখন আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। গত ৩১ ডিসেম্বর চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে আক্রান্ত প্রথম রোগীর সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর থেকে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।

Advertisement

এ পর্যন্ত চীনে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১৩ জনে। এছাড়া এ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ৯০০০ ছাড়িয়ে গেছে। মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

তবে করোনাভাইরাস বিশ্বে যেমন আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে, তার চেয়ে বেশি আতঙ্ক নিয়ে এসেছিল কয়েকটি রোগ। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইবোলা, এইচআইভি/এইডস, কলেরা, ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্লেগ, বসন্ত, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়া। সারা বিশ্বে কয়েকশ কোটি মানুষ এসব রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন এবং এখনও আক্রান্ত হচ্ছেন।

ইবোলা২০১৪ সালে বিশ্বে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়ায় ইবোলা ভাইরাস। ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে এ ভাইরাস পশ্চিম আফ্রিকায় মহামারি আকার ধারণ করে। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় দফায় ইবোলা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হওয়ায়, স্বাস্থ্যগত বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

Advertisement

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে প্রথম ইবোলা ভাইরাস শনাক্ত হয়। মধ্য আফ্রিকার ইবোলা নদীর তীরে প্রথম সংক্রমণ ঘটে বলে নদীটির নামেই নামকরণ করা হয় ভাইরাসটির। বাদুড়ের খাওয়া ফল থেকে মানুষের দেহে প্রথম প্রবেশ করে ইবোলা ভাইরাস। পরে তা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে থাকে। দেহ থেকে নিঃসৃত বিভিন্ন তরল থেকে এ রোগ ছড়ায়। ইবোলাতে আক্রান্ত হয়ে ৭ হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, যার মধ্যে কয়েকশ চিকিৎসক ও নার্স আছেন।

এইডস১৯৮০ সালের শুরুর দিকে আফ্রিকায় হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস (এইচআইভি) দ্বারা সংক্রমিত এইডস রোগের সূচনা ঘটে। এ পর্যন্ত প্রায় ৮ কোটি মানুষ এইডসে আক্রান্ত হয়েছে এবং সাড়ে ৩ কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।

গত বছর জাতিসংঘের এইডসবিষয়ক জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইডস তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে জানায়, বর্তমানে প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এইডসে আক্রান্ত। বিশেষ করে আফ্রিকাতে এইডসে আক্রান্ত রোগীর পরিমাণ বেশি।

তবে ২০১০ সালের পর থেকে এইডসে মৃত্যুর হার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে এসেছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। ২০১৮ সালে এইডসে আক্রান্ত হয়ে ৭ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, ২০১০ সালের তুলনায় যা প্রায় ৩৩ শতাংশ কম।

Advertisement

কলেরা১৮০০ সাল থেকে সারা বিশ্বে কলেরা মহামারি শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত কয়েক লাখ মানুষ এতে আক্রান্ত হয়েছে এবং প্রতিবছর কয়েক হাজার মানুষ কলেরায় প্রাণ হারিয়েছেন।

চীন, রাশিয়া ও ভারতে কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ৪ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ শতকে কলেরা সবচেয়ে বড় আঘাত হানে। এতে দুই দশকে দেশটির প্রায় ৮ লাখ মানুষ প্রাণ হারান।

২০১৭ সালে ইয়েমেনে এক সপ্তাহে কলেরায় অন্তত ১১৫ জনের মৃত্যু হয়। কলেরার কারণে দেশটির রাজধানী সানায় জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল।

ইনফ্লুয়েঞ্জাবিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা অনুযায়ী, ১৯১৮ থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের প্রায় ৫ কোটি মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জাতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এর পরিমাণ ১০ কোটিরও বেশি হতে পারে।

এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের উদ্ভব হয়েছে, যেগুলো বিশ্বব্যাপী মানুষের কারণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। একই ভাইরাসের বিভিন্ন জাতি মানুষ, পাখি, শূকর প্রভৃতি জীব প্রজাতির মাধ্যমে এটা ছড়ায়।

প্লেগবিশ্বের সবচেয়ে মারাত্মক মহামারির দৃষ্টান্ত হিসেবে প্লেগকে উল্লেখ করা হয়। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে ২০ কোটিরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। বলা হয়ে থাকে, ১৩৪৬ থেকে ১৩৫০ সালের মধ্যে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন।

‘দ্য ব্ল্যাক ডেথ’ খ্যাত এ রোগ সম্পর্কে সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, ইয়ারসিনিয়া পেস্টিস নামক এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার মাধ্যমে প্লেগ হয়। এই ব্যাক্টেরিয়া প্রধানত ইঁদুর বা মাছির মধ্যে পাওয়া যায়। এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত ইঁদুর বা মাছির কামড়ের দ্বারা মানুষ এবং অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের আক্রান্ত করতে পারে।

এই উপমহাদেশেও প্লেগ হানা দিয়েছিল। ১৮৯৬ সালের শেষের দিকে ভারতের বোম্বে (মুম্বাই), পুনেসহ মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে প্লেগ মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় মহারাষ্ট্রে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

গুটিবসন্তবিশ্বে এ পর্যন্ত যতো রোগ মহামারি আকার ধারণ করেছে তার মধ্যে গুটিবসন্তকে মোটামুটি নির্মূল করা গেছে। ষোড়শ শতাব্দীর শুরু থেকে এ রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু। বিংশ শতাব্দীতে গুটিবসন্তে প্রায় ৫০ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

আগে গুটিবসন্তে মৃত্যু হার ছিল ৩০ শতাংশ, যদিও এর অধিকাংশ উপাদানগুলো প্রাণঘাতী ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৭৯ সালে গুটিবসন্ত নির্মূলের ঘোষণা দেন।

যক্ষ্মাবর্তমানে যক্ষ্মা (টিবি) ও এইডসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত। তার মধ্যে অর্ধেকের যক্ষ্মা নির্ণয় করা হয়নি।

গবেষণা বলছে, গত দুই শতাব্দীতে ১০০ কোটি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ধারণা, ২০২০ সালের মধ্যে ৬ থেকে ৯ কোটি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারাবেন।

যক্ষ্মা সাধারণত ফুসফুসে ছড়ায়। তবে এটি শরীরের অন্যান্য অঙ্গ প্রতঙ্গকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। যক্ষ্মা আক্রান্ত ব্যক্তির কফ, হাঁচি বা থুতু থেকে বাতাসের মধ্যে দিয়ে সহজে এই রোগ ছড়িয়ে পড়ে।

ম্যালেরিয়ামার্কিন সাংবাদিক সোনিয়া সাহা তার ‘দ্য ফিভার : হাউ ম্যালেরিয়া হ্যাজ রুলড হিউম্যান কাইন্ড অর ফাইভ থাউজেন্ড ইয়ারস’ গ্রন্থে বলেছেন, ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিশ্বের ৫ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর ৮৫ লাখ মানুষ ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এটি মূলত একটি মশাবাহিত সংক্রামক রোগ, যার মূলে রয়েছে প্লাজমোডিয়াম গোত্রের প্রোটিস্টা (এক ধরনের অণুজীব)।

১৯৯৯ সালের একটি প্রতিবেদনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছিল, ১৯ শতকে ২০ কোটির কাছাকাছি মানুষের প্রাণহানির কারণ হবে ম্যালেরিয়া। এই হিসাবটি আমলে নিলে এটা পরিষ্কার হয় যে, ম্যালেরিয়া বিশ্বের সবচেয়ে মহামারি রোগ।

এমএসএইচ/এমএস