মতামত

ষড়যন্ত্র যারই হোক ক্ষতি বাংলাদেশ ক্রিকেটের

ষড়যন্ত্র-রাজনীতি-কূটনীতি। এই তিন স্টাম্পের ওপর যেন এখন ‘বাংলাদেশ –ক্রিকেট’ নামক দু’খানা বেল! আর তার সামনে যেভাবে পারেন বল ফেলেই যাচ্ছেন। লক্ষ্য- স্টাম্পে আঘাত এনে ‘বাংলাদেশ-ক্রিকেট ’ নামক বেল দু’খানাকে শুন্যে উড়িয়ে মাটিতে ফেলে দেয়া। বেল হয়তো পড়েনি। কিন্তু কেউ কেউ এলবিডাব্লিউ-র সৌজন্যে একটা দু’টো উইকেট পেয়েছেন। আবেগাশ্রয়ী ক্রিকেট সমর্থনে যাদের প্রাণ সমর্পিত তাঁদের অনেকের কাছে কথাগুলো একটু এলোমেলো মনে হতে পারে। কিন্তু আবেগের আস্তরণটা সরিয়ে বাস্তবে দাঁড়িয়ে যদি এই মুহূর্তে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে দেখার চেষ্টা করেন তিনি হয়তো অন্যরকম কিছু দেখতে পারেন।ষড়যন্ত্রের কথাটা জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে ক্রিকেট প্রশাসনের শীর্ষ থেকে অনেকের মুখে। আর ষড়যন্ত্রটা দেশি-বিদেশি বলেই দাবি তাঁদের। ষড়যন্ত্রের কথাটাকে সরাসরি নাকচ করে দেয়ারও কোনো কারণ নেই। তবে সেই ষড়যন্ত্র হঠাৎ করে আবিষ্কৃত হচ্ছে বিস্ময়ের কারণ সেখানে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মহল দুইভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল যখন টেস্ট প্লেয়িং দেশগুলোকে দুটো স্তরে ভাগ করার চিন্তা শুরু হয়েছিল তখনই। আইসিসি র‌্যাংকিং -এ দুটো টায়ার হয়তো হয়নি। কিন্তু ‘বিগ থ্রি’ করে ব-কলমে সেই টু টায়ার টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রি কি করা হয়নি? ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া-ভারত নিজেদের আর্থিক এবং ক্রিকেটীয় স্বার্থ ঠিক রেখে বাকিদের  দিকে কিছুটা উচ্ছিষ্ট ছিটিয়ে দিচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিকেট বিশ্বে সমতার ভিতের মূলে আঘাত করা হয়েছিল। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করেননি। যুক্তি ছিল; প্রতিবাদ করে কিছু হবে না। ওদের সঙ্গে পারা যাবে না! তারচেয়ে বরং ওদের সঙ্গে থাকলে কিছু পাওয়া যাবে। এবং বাংলাদেশও সেই পথে হেঁটেছিল। এখন সেই বিগ থ্রি-র অন্যতম অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশের গায়ে ‘অনিরাপদ জায়গা’-র সিল ছাপ্পর লাগিয়ে দিয়ে সিরিজ বাতিল করলো! সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে সাউথ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলও তাঁদের সফর স্থগিত করলো। এবং কি নিখুঁত টাইমিং করলো তারা! অস্ট্রেলিয়া এবং সাউথ আফ্রিকা তাঁদের সফর স্থগিত করলো  ঠিক সেই সময় যখন বাংলাদেশ বাড়াবাড়ি রকম দুঃসাহস দেখিয়ে তাঁদের নারী ক্রিকেট দলকে পাকিস্তান সফরে পাঠালো! নিজের ডিফেন্স ঠিক নেই, অথচ বাংলাদেশ স্টেপ আউট হয়ে ছক্কা হাঁকাতে গেলো! অন্য কোনো দেশ যখন পাকিস্তানকে ক্রিকেট খেলার জন্য নিরাপদ মনে করছে না, কেউ খেলতে আসছে না তখন বাংলাদেশ সেখানে নারী দল পাঠিয়ে পাকিস্তানকে ক্রিকেটের জন্য নিরাপদ সার্টিফিকেট দেয়ার উদ্যোগ নিতে গেলো কেন? মাস কয়েক আগে পাকিস্তানে একটা  সংক্ষিপ্ত সিরিজ খেলতে এসেছিল জিম্বাবুয়ে কিছু ডলারের জন্য। সেই সিরিজ চলার সময়ও মাঠের বাইরে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল। অতএব জিম্বাবুয়ের কাছ থেকে পাকিস্তান ‘ক্রিকেটের জন্য নিরাপদ’ সার্টিফিকেট টা পায়নি। তারপরও বাংলাদেশ কেন নারী ক্রিকেট দলকে পাকিস্তান পাঠালো, এই প্রশ্ন ক্রিকেট বিশ্বে ঘুরপাক খাচ্ছে। অনেকের ধারণা বাংলাদেশ পাকিস্তানের পাতা ফাঁদে পা রাখলো। বাংলাদেশ নারী দলের সফর শেষ হলে পাকিস্তান দাবি করতেই পারে; নারী দল যেখানে সফর করতে পারলো সেখানে বাংলাদেশ জাতীয় দল কেন সফর করবে না? এবং তাঁদের সেই কথাটা তখন অনেক যুক্তিগ্রাহ্য মনে হবে আপাতদৃষ্টিতে।তবে সেই যুক্তি ক্রিকেট বিশ্বে খুব একটা গ্রাহ্যতা পাবে না তা ঠিক। কারণ, ক্রিকেটের জন্য পাকিস্তানিরা নিজেরাই নিজেদের দেশটাকে নিরাপদ মনে করতে পারছে না। তাই তাদের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি লিগ পিসিএল  এর আয়োজন করা হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে। আর তার আগে অস্ট্রেলিয়া এবং সাউথ আফ্রিকা যৌথভাবে আওয়াজ তুলে দিয়ে গেলো বাংলাদেশে নিরাপত্তার হুমকি আছে! কিন্তু হুমকিটা কি সেটা পরিষ্কার করে বললেন কি তাঁরা? কিংবা বাংলাদেশ কি তাঁদের কাছে পরিষ্কার করে জানতে চাইলো, হুমকিটা কীসের? শুধু বার বার বলা হলো আমরা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট দলকে সরকার কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের (ভিভিআইপি) নিরাপত্তা দেবো। তাঁরা কি কারণে বাংলাদেশকে অনিরাপদ মনে করছেন, কাদের কাছ থেকে হুমকি পেয়েছেন, কিংবা নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে এই বিষয়ে নিশ্চিত হলেন কীসের ভিত্তিতে তাঁরা। এ প্রশ্ন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন রয়ে গেলো। সব মিলিয়ে ষড়যন্ত্রের কথাটা বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ষড়যন্ত্র হলে তা থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ বাংলাদেশকেই নিতে হবে। সেই উদ্যোগটা কি দৃশ্যমান? ‘আইসিসির সভায় বিষয়গুলো তুলবো’- গোছের কথায় আস্থা রাখা যায় না অনেক কারণে। আইসিসি নামক প্রায় নখদন্তহীন সংস্থাটিতে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাংলাদেশের সাবেক বোর্ড সভাপতি আ হ ম মুস্তাফা কামালকে যখন আগের জোরে কোনো এক শ্রীনিবাসন বিশ্বকাপ ট্রফি দিতে দিলেন না, তখন বোঝা গেছে আইসিসি-তে বাংলাদেশের অবস্থান কতোটা নড়বড়ে! সেই আইসিসি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের নালিশ শুনবে, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। আর সিরিজ আয়োজন, সিরিজ বাতিল কিংবা স্থগিত এসব কিছু এখন একেবারেই দ্বিপাক্ষিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব বিষয়ে সাফল্যেও একমাত্র হাতিয়ার  ক্রিকেট কূটনীতিতে দক্ষতার পরিচয় দেয়া। বাংলাদেশ ক্রিকেট কূটনীতিতে কতোটা দক্ষতা দেখাতে পারে সেটা বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ৯ সেপ্টেম্বর আইসিসির সভা পর্যন্ত।তবে ক্রিকেট নিয়ে দেশের মধ্যে রাজনীতি শুরু হয়েছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘ব্লেম গেম’ বড় এক অনুঘটক। এবার সেখানে ক্রিকেট না ঢুকে পড়ে। অনেক মন্ত্রী বলতে শুরু করেছেন, বিরোধী দলের ষড়যন্ত্রে অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছে! দায়িত্বশীল এই সব লোকের কথাশুনে একটা কথা মনে পড়ছে। বছরখানেকের একটু বেশি সময় আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ অনূর্ধ -১৯ দলটা বাংলাদেশ সফর বাতিল করে চট্টগ্রাম থেকে দেশে ফিরে গিয়েছিল। সেই সময় তাঁদের সিরিজ খেলানোর জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড কি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছিল? পারলে বোধহয় সিরিজটা মাঝপথে পণ্ড হতো না।অস্ট্রেলিয়া দলের বাংলাদেশ সফর স্থগিতের মধ্যে ষড়যন্ত্র, রাজনীতি, কূটনীতি যাই খুঁজে বেড়ানো হোক, ক্ষতি কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই হলো। পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে এখন অনেকে একই সরণিতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করবে।লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ইনজুরি টাইম’ ‘এক্সট্রা টাইম’ ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তিনি কাজ করেছেন দেশের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে, টেলিভিশন এবং দেশি-বিদেশি রেডিওতে।এইচআর/এমএস

Advertisement