প্রবাস

করোনাভাইরাস : আতঙ্কে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা

ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে করোনাভাইরাস। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চীনে মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে তা পৌঁছেছে ১০৮ জনে। ফলে করোনাভাইরাস চীনে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে তুলছে। তবে এখন পর্যন্ত চীন অবস্থানরত কোনো বাংলাদেশি আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।

Advertisement

ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ২ হাজার ৭৬২ জন। এই রোগের লক্ষণ পাওয়া গেছে ৫ হাজার ৭৯৪ জনের কাছে। ভাইরাস থেকে মুক্তি পেয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে ৫১ জন। হুবেই প্রদেশ উহান থেকেই প্রথম ছড়িয়ে পড়ে এই ভাইরাস।

এদিকে ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল উহানে অবস্থিত বাংলাদেশ কমিউনিটিতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। উহান শহরে সকল ধরনের গণপরিবহন তথা বাস, ট্রেন, মেট্রো এবং বিমানবন্দর পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে দেশটির সরকার। উহান ও হুবেইসহ চীনের একাধিক জায়গাকে নজরবন্দি করা হয়েছে, যাতে ভাইরাসের সংক্রমণ সঙ্গে সঙ্গে না ছড়িয়ে পড়ে।

এমন অবস্থায় উহান শহর কার্যত ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে। শহরে রাস্তা এখন জনমানব শূন্য। ক্যাম্পাসের আশপাশে সুপারশপগুলো বন্ধ হওয়াতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। চীনের বড় উৎসবের (চাইনিজ নিউ ইয়ার) কারণে সরবরাহ কম থাকায় সকল ধরনের নিত্যপ্রয়োজণী দ্রব্যাদি পেতে বেগ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

Advertisement

উহান ছাড়াও চীনের অন্যান্য শহরে বসবাসরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে ফেরত যেতে চাচ্ছে। তারা চীনে বাংলাদেশি দূতাবাসসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

উহান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ড. মো. এনামুল হক বলেন, সম্প্রতি চায়নার হুবেই প্রদেশের উহান শহরের করোনাভাইরাস সম্পর্কে মোটামুটি বিশ্বের সকলেই অবগত। আমি এই উহান শহরে দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর যাবৎ আছি। যাইহোক, সন্দেহ নেই বর্তমানে আমরা কঠিন সময় অতিবাহিত করছি। এরপরও বলব বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা যারা উহান শহরে আছি তাদের জন্য উহান শহরই করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সবচেয়ে নিরাপদ শহর। কারণ, এটি মোকাবিলা করার জন্য এই শহরে যে পরিমাণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বিশ্বের অন্য কোথাও এত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। চায়নার অন্য শহরগুলো থেকে উহানে করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য স্পেশালিস্ট ডাক্তার নিয়ে আসা হয়েছে।

তিনি বলেন, চিকিৎসকরা তাদের সবচেয়ে বড় উৎসবে (চাইনিজ নিউ ইয়ার) বাড়িতে না গিয়ে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালগুলোর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদেরকে এই পরিস্থিতি প্রতিরোধ ও মোকাবিলা করার নির্দেশিকা নিয়মিতভাবে জানানো হচ্ছে এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। যেমন, আজ সকালে আমার অফিস থেকে আমাকে জানানো হয়েছে আমি যেন প্রতিদিন আমার শরীরের তাপমাত্রা সম্পর্কে তাদেরকে রিপোর্ট করি। অর্থাৎ যদি কোনো অসংগতি/বিপদ দেখা দেয় তাহলে তারা যেন দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

উহানে সেন্টাল চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত শামিমা সুলতানা বলেন, ‘এখানের অবস্থা খুব একটা ভালো না। আমি আতঙ্কের মধ্যে আছি। দুই বাচ্চা নিয়ে আমি উহানে আছি, আমার বিষয়টা ডিফিকাল্ট। রাস্তাঘাটে কোনো মানুষ নেই। কিছুদিন পর আমার খাবার-দাবারের সংকট দেখা দেবে। সরকারের প্রতি আমার অনুরোধ এখানে আমরা যারা বাংলাদেশিরা আছি তারা আক্রান্ত হওয়ার আগেই ব্যবস্থা নিলে ভালো হয়। সবাইকে নিরাপদে বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।’

Advertisement

ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জেরি জিংচু ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে অধ্যয়নরত, ট্রাভেলেটস অব বাংলাদেশ- ভ্রমণকন্যার সহ-সভাপতি টুম্পা প্রামাণিক বলেন, নিসন্দেহে আমরা করোনাভাইরাসের জন্য খুবই খারাপ সময় পার করছি। এর তুলনা করার সাধ্য নাই আমার। আপনারা দয়া করে ফেসবুকে করোনাভাইরাস নিয়ে উল্টাপাল্টা স্ট্যাটাস দেবেন না। সতর্ক থেকে মাস্ক ব্যবহার করুন।

তিনি বলেন, সাবধানে থাকুন। আমরা এখনো ভালো আছি, বেঁচে আছি। আমরাও দেশে যেতে চাই, তবে ভাইরাস নিয়ে নয়। আমরা নিয়ম মানছি, সতর্ক আছি। আমরা বিশ্বাস করি আমরা অবশ্যই এর কঠিন সময় শেষে সুস্থ অবস্থায় হাসি নিয়ে মায়ের কোলে ফিরে যাব।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশি কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যম ও মানুষ দায়িত্ব নিয়ে এমন কিছু ছড়াচ্ছে যেগুলো দেখলে আমাদের বেঁচে থাকা লড়াই করার মনোবল এমনিই কমে যাবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ-চায়না ইয়ুথ স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এ. এ. এম. মুজাহিদ জানায়, চীনে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের এখনও পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। তবে আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাদের স্বেচ্ছাসেবক দলটি উহানসহ অন্যান্য সিটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে তাদেরকে উদ্বিগ্ন না হইয়ে নিজ নিজ বাসস্থানে নিরাপদে থাকতে বলা হচ্ছে।

তিনি জানান, বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের তাদের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশাবলী মেনে চলতে বলা হচ্ছে। প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বা দুটি করে ক্যান্টিন খোলা রাখা আছে। তাই প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের না হতে বিশেষ অনুরোধ জানানো হচ্ছে সবাইকে।

চীনে বাংলাদেশি দূতাবাসের উপ-প্রধান মাসুদুর রহমান করোনাভাইরাসের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদকে জানান, আমাদের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী উহানে প্রায় ৩৫০ বাংলাদেশি আছেন। উহানে এখন অচলাবস্থা বিরাজ করছে। সেখানে বা চীনের অন্য কোনো স্থানে বাংলাদেশি কেউ করোনাভাইরাসে আক্রান্তের খবর নেই। আমি ইতোমধ্যে ঢাকায় জানিয়েছি এখানকার পরিস্থিতি।’

বাংলাদেশ দূতাবাস কোনো খোঁজ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ করছে দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশি ছাত্ররা। ছাত্রদের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা বেশিরভাগ অভিযোগ পাচ্ছি উহান শহর থেকে। কিন্তু শহরটি অচলাবস্থায় আছে। দূতাবাসে ২৪ ঘণ্টা হটলাইন সেবা দিচ্ছি। দূতাবাস কর্মকর্তারা পালাক্রমে ডিউটি দিচ্ছেন। আমরা উহানসহ অন্যান্য লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছি। এখানে ওইচ্যাটে বাংলাদেশি গ্রুপ আই এম ইন উহান নাউ খোলা হয়েছে। এই গ্রুপের আমরাও আছি এবং সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা বাংলাদেশ সরকার, চীন সরকার এবং চীন সরকার স্থানীয় প্রশাসনের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি।

তিনি বলেন, ‘অনেকে অভিযোগ করেছে যে উহানে দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু আসল ঘটনা হচ্ছে ওই শহরে কয়েকটি বড় শপিং মল খোলা। যেখানে সবধরনের জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। ওই মলগুলোতে যাওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে শাটল বাসেরও ব্যবস্থা আছে।

এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশিদের দেশে ফেরার পরামর্শ দিয়েছেন। হুবেই প্রদেশের উহান শহর ছাড়া অন্য শহর থেকে বিমানযোগে দেশে ফেরার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

ছাইয়েদুল ইসলাম, চীন প্রতিনিধি/এমআরএম