আন্তর্জাতিক

করোনাভাইরাস : ঘুম নেই, কাঁদছেন টানা কাজে ক্লান্ত চিকিৎসকরা

চীনে করোনাভাইরাস এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে যে, কোনোভাবেই এই ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকানো যাচ্ছে না। যতই সময় যাচ্ছে এই ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছেই। এমন অবস্থায় রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে টানা কাজ করতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। একটু বিশ্রাম বা ঘুমের সময়ও পাচ্ছেন না তারা।

Advertisement

সম্প্রতি একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, টানা কাজের চাপ আর ক্লান্তিতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেক চিকিৎসক। অনেকেই চিৎকার করছেন এবং কেঁদে যাচ্ছেন। ওই ভিডিও দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, সেখানকার পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ।

চিকিৎসকদের ওই ভিডিও দেখলে যে কারো চোখে পানি চলে আসবে। এর আগে আরও একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছে, চিকিৎসকরা টয়লেটে যাওয়ার সময়ও পাচ্ছেন না। এত বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছেন যে, চিকিৎসকরা টয়লেটেও যেতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে প্রাপ্ত বয়স্কদের ডায়াপার পরেই চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

উহানে নজিরবিহীন পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করতে হচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীদের। তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিশ্রাম ছাড়াই কাজ করে যাচ্ছেন। বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে শহরের হাসপাতালগুলো লোকজনে পরিপূর্ণ। কোথাও পা ফেলারও জায়গা নেই। সব হাসপাতালেই রোগীর ভিড় লেগে আছে।

Advertisement

রোগীদের শরীর থেকে যেন এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে না পারে সেজন্য পুরো শরীর ঢাকা পোশাক এবং মাস্ক পরে চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন হাসপাতালের কর্মীরা। এই পোশাক বার বার খোলাটাও বেশ কঠিন ও সময় সাপেক্ষ। এমন পরিস্থিতিতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে বার বার পোশাক বদলাতে রাজি নন তারা।

এদিকে সামাজিক মাধ্যমে এক চীনা চিকিৎসক বলেন, আমরা জানি যে আমাদের এই সুরক্ষিত পোশাকটিই হয়েতো আমাদের কাছে সর্বশেষ। আমরা কোনো কিছুই নষ্ট করতে চাচ্ছি না।

একটি ভিডিওতে দেখা গেছে উহানের একটি হাসপাতালে এক নারী সাদা রংয়ের পোশাক পরে আছেন। এটি একটি মেডিকেল কোট। তিনি চিৎকার করে কাঁদছেন আর বলছেন, আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

তার সহকর্মীরা তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন কিন্তু কিছুতেই তার কান্না থামছে না। অপর এক ভিডিওতে এক চিকিৎসককে হতাশা প্রকাশ করতে দেখা গেছে। হাসপাতালে প্রয়োজনীয় জিনিসের অভাব দেখা দেওয়ায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ওই হাসপাতালে রোগী এতো বেশি হয়ে গেছে যে, চিকিৎসা দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ শয্যা দরকার তা নেই।

Advertisement

ওই চিকিৎসককে বলতে শোনা যাচ্ছে যে, আমাদের আর চিকিৎসকের প্রয়োজন নেই। এখানে ইতোমধ্যেই অনেক চিকিৎসক আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে পরিমাণ শয্যা দরকার তা নেই। তার সহকর্মীরা তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তিনি কোনোভাবেই শান্ত হতে পারছিলেন না।

মূলত চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, নেপাল, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্রেও লোকজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে।

হুবেই প্রদেশের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেখানে ২৪ জনের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। সোমবার পর্যন্ত সেখানে এক হাজার ২৯১ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন এই ভাইরাসের নাম দিয়েছে ২০১৯ নোভেল করোনাভাইরাস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে চীনে সফর করেছেন এমন লোকজনের মাধ্যমেই এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। সে কারণে অনেক দেশই এই ভাইরাসের প্রকোপ ঠেকাতে চীন সফরে নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা এনেছে।

সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মৃতের সংখ্যাও বাড়ছে। এখন পর্যন্ত সেখানে ১০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নতুন করে এক হাজার ৩শ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। ফলে এখন পর্যন্ত চার হাজার ১৯৩ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

হুবেই প্রদেশে ইতোমধ্যেই সেনা মোতায়েন করেছে চীন। মাস্ক পরে সোমবারই কাজে লেগে গেছেন সেনা সদস্যরা। তারা সেখানে প্রয়োজনীয় জিনিস-পত্র সরবরাহ করছেন। সোমবার চীনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, চীন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে এই ভাইরাস আরও শক্তিশালী হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ কী?

এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শুরুতে জ্বর ও শুষ্ক কাশি হতে পারে। এর সপ্তাহখানেক পর শ্বাসকষ্টও দেখা দেয়। অনেক সময় নিউমোনিয়াও হতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ হওয়ায় তাদের হাসপাতালে ভর্তি করা লাগে। তবে এসব লক্ষণ মূলত রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরই জানা গেছে।

সেক্ষেত্রে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার একদম প্রাথমিক লক্ষণ কী বা আদৌ তা বোঝা যায় কি-না তা এখনও অজানা। তবে নতুন এই করোনাভাইরাস যথেষ্ট বিপজ্জনক। সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের লক্ষণ থেকে এটি মৃত্যুর দুয়ার পর্যন্তও নিয়ে যেতে পারে।

এই ভাইরাস বিপজ্জনক হয়ে উঠছে কারণ এ বিষয়ে এখনও ভালোভাবে জানা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে এই ভাইরাস কতটা বিপজ্জনক এবং এটা একজন থেকে আরেকজনের শরীরে কীভাবে ছড়িয়ে পড়ছে এ বিষয়গুলো এখনও পরিষ্কার নয়।

এখন পর্যন্ত এটা জানা সম্ভব হয়েছে যে, এই ভাইরাস থেকে নিউমোনিয়া হবার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই এটা অনেক ভয়াবহ হতে পারে। অপরদিকে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের ক্ষমতা আরও প্রবল হচ্ছে এবং সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন।

চীনে এই ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৫৮ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছে। অপরদিকে থাইল্যান্ডে ৮, জাপানে ৪, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৪, যুক্তরাষ্ট্রে ৫, ভিয়েতনামে ২, সিঙ্গাপুরে ৫, মালয়েশিয়ায় ৪, নেপালে ১, ফ্রান্সে ৩, অস্ট্রেলিয়ায় ৫, কানাডায় ১, জার্মানিতে ১ এবং কম্বোডিয়াতে একজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

টিটিএন/জেআইএম