বিশ্বের নতুন উপদ্রব করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুতগতিতে। এতে উৎসস্থল চীনে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ৫৬ জন। আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছুঁয়েছে বলে দাবি উঠেছে। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপের দিকে যাওয়ায় অন্তত ১৮টি শহরে ভ্রমণে ও পরিবহন চলাচল নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
Advertisement
এর মধ্যে ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে এশিয়া-ইউরোপ-আমেরিকার কমপক্ষে ১২টি দেশে। প্রতিষেধক আবিষ্কৃত না হওয়ায় আতঙ্ক রয়েই যাচ্ছে। এর ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতেও এর প্রভাব পড়বে। তবে সেটা কতটা মারাত্মক হবে তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের।
২০০২-০৩ সালের দিকে করোনাভাইরাসের সমগোত্রীয় সার্সের (সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোম) প্রাদুর্ভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বিশ্ব অর্থনীতি। ওই ভাইরাসটিরও উৎপত্তি হয়েছিল চীনে। এবার নতুন ভাইরাসের কারণেও চীনা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। চীনা নববর্ষ উপলক্ষে লাখ লাখ পর্যটক ভ্রমণে বের হওয়ার মুহূর্তেই নিষেধাজ্ঞা দিতে হয়েছে ১৮টি শহরে। ফলে বড় আঘাত পড়েছে দেশটির পর্যটন শিল্পে।
পরিবহন-বাণিজ্যে ক্ষতিভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চীনের নববর্ষ উপলক্ষে বিনোদন ও উপহারসামগ্রী কেনাবেচায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষেই সবচেয়ে বেশি ছড়াচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও আতঙ্কের কারণে বেশিরভাগ মানুষই ঘর ছেড়ে বের হচ্ছেন না। অনেক শহরে গাড়ি চলাচল ও দোকানপাট বন্ধ রয়েছে। ফলে অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে।
Advertisement
করোনাভাইরাসের উৎসস্থল উহান শহর দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পরিবহনকেন্দ্র। শহরটিতে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় বেশ বিপাকে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট ভোক্তা-ব্যবসায়ীরা। পণ্য পরিবহনে শুরু হয়েছে বড় সংকট। শিল্পপণ্য সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে অসংখ্য পণ্যের চালান বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তা অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। এছাড়া স্থানীয় লোকজন কর্মক্ষেত্রে যোগ না দেয়া বা দিতে না পারার কারণেও দেশটির আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে।
চিকিৎসাচীনে অসুস্থদের মধ্যে যাদের স্বাস্থ্যবীমা করা আছে, তাদের চিকিৎসার জন্য বিপুল অংকের অর্থ খরচ করতে হবে দেশটির সরকারি-বেসরকারি বীমা কোম্পানিগুলোকে। অন্য দেশগুলোতেও এই ভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়লে সেখানেও একই সংকট সৃষ্টি হবে। যদিও সেটি পুরোপুরি চীনের সমান না হলেও আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ একেবারে নগণ্যও হবে না।
এর প্রভাব কতটা থাকবে তা নির্ভর করছে মূলত করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হারের ওপর। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, অনেকেই এই অসুখ থেকে পুরোপুরি সেরে উঠেছেন, তবে মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক।
ওষুধ-শেয়ারবাজারনতুন করোনাভাইরাসের জন্য শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু হয়েছে, বিশেষ করে চীনে। যদিও সেটি এখন পর্যন্ত খুব একটা বড় আকার ধারণ করেনি। এমনকি ভাইরাস সংকটের মধ্যেই সাংহাই কম্পোজিট ইনডেক্স গত ছয় মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ সূচকে পৌঁছেছে।
Advertisement
এছাড়া এমন পরিস্থিতিতে কিছু ব্যবসায় অনেক বেশি লাভও হতে পারে; যেমন- ওষুধ। মানুষ ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক লক্ষণ দেখে সে অনুযায়ী ওষুধ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এছাড়া করোনাভাইরাসনিরোধী ওষুধ বাজারে ছাড়তে পারলে আরও বেশি লাভের মুখ দেখবেন ব্যবসায়ীরা।
এখন পর্যন্ত ২০১৯-এনসিওভি’র কোনও প্রতিষেধক আবিষ্কৃত না হলেও জনসন অ্যান্ড জনসনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পল স্টোফেল জানিয়েছেন, তার দল ইতোমধ্যে নতুন ভাইরাসের প্রতিষেধকের ‘মূল কাজ’ সম্পন্ন করে ফেলেছেন। আগামী এক বছরের মধ্যেই এটি বাজারে ছাড়া সম্ভব হবে।
এছাড়া ভাইরাস আতঙ্কের কারণে মাস্ক, হাতমোজা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, থার্মোমিটার প্রভৃতির চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। যেসব কোম্পানি এগুলো তৈরি করে তাদের শেয়ারেরও দাম বেড়ে গেছে। দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, গত সপ্তাহে মাত্র দু'দিনে প্রায় আট কোটি মাস্ক বিক্রি করেছে আলিবাবার মালিকানাধীন তাওবাও। জানুয়ারির ১৯ থেকে ২২ তারিখের মধ্যে জেডি ডটকম মাস্ক বিক্রি করেছে অন্তত ১২ কোটি ৬০ লাখ পিস। এছাড়া তাদের হ্যান্ড স্যানিটাইজারের স্টকও শেষ হয়ে গেছে। বিক্রি বেড়েছে থার্মোমিটার, চশমাসহ ঠান্ডাজনিত রোগের বিভিন্ন ওষুধেরও।
পুনরুদ্ধারএ বিষয়ে সবচেয়ে উপযুক্ত উদাহরণ সার্স প্রাদুর্ভাবের ঘটনা। বিশ্ব অর্থনীতিতে এর ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার। লন্ডনভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ক্যাপিটাল ইকোনমিকসের জেনিফার ম্যাককেওন জানান, ২০০৩ সালে সার্সের কারণে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি নেমে গিয়েছিল পুরো এক শতাংশ।
অর্থনীতিতে এটা অনেক বড় ধাক্কা হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই সেই ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হয়। তিনি বলেন, সে সময় যেসব বিষয় বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করেছিল তাদের চিত্রটি বেশ জটিল। তার মতে, সার্স অনেক ভয়ঙ্কর এবং বিস্তৃত ভাইরাস হলেও বৈশ্বিক জিডিপিতে (অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ) এর স্থায়ী ক্ষতি বাছাই করা বেশ কঠিন।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহান শহরে প্রথমবারের মতো নতুন এই ভাইরাসটি ধরা পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নতুন এই ভাইরাসের নাম দিয়েছে ২০১৯-এনসিওভি। ধরা পড়ার এক মাসও হয়নি, এরই মধ্যে শুধু চীনেই অন্তত ৫৬ জন মারা গেছে, আক্রান্ত হয়েছে দুই হাজারের বেশি মানুষ। যদিও দেশটির এক চিকিৎসাকর্মী দাবি করেছেন, চীনা সরকার মিথ্যা বলছে। সেখানে এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
শনিবার পর্যন্ত অন্তত ১৮টি শহরে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ও চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপ হওয়ায় করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।
চীনের উহান শহরে প্রায় ৮৯ লাখ মানুষের বসবাস। মূলত ওই শহরে প্রাদুর্ভাব ঘটার পর ভাইরাসটি বেইজিংসহ অন্যান্য প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া প্রতিবেশী দেশ জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, ম্যাকাও, ভারত, নেপাল এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াতেও এই ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। এমনকি ইউরোপেও ছড়িয়েছে করোনাভাইরাস। ফ্রান্সে অন্তত তিনজন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া, একজনের শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে সন্দেহ করছে ইসরায়েল।
সূত্র: বিবিসি
কেএএ/টিটিএন/এমএস