মতামত

ক্রিকেটীয় জয়ের অন্যরকম স্মারক

ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৭১। ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ম্যাচ। পিসিসিবি একাদশ বনাম ইন্টারন্যাশনাল একাদশ। চার দিনের ম্যাচটা শুরু হয়েছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান একাদশে জায়গা পান এক বাঙালি ক্রিকেটার। স্বাভাবিকভাবে বাঙালির আগ্রহ বেড়ে যায় সেই ম্যাচ নিয়ে। চতুর্থ দিন ১ মার্চ বাঙালির আগ্রহ শিফট হয়ে যায় পূর্বানী হোটেলে। বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ নেতাদের নিয়ে বৈঠক করছিলেন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে করণীয় ঠিক করতে। হঠাৎ পাকি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করলেন! বিস্ময়ে-ক্ষোভে-রাগে উত্তাল গোটা পূর্ব পাকিস্তান। সেই ক্ষোভের বারুদ জ্বলে উঠল ঢাকার রাজপথে। যার প্রথম অগ্নিসংযোগ ঢাকা স্টেডিয়ামের গ্যালারি। ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ক্ষুব্ধ ক্রিকেট দর্শকরা বেরিয়ে পড়েন। আন্দোলনে-স্লোগানে ঢাকার রাজপথ মুখরিত হয়ে ওঠে।

Advertisement

বাঙালির বুঝতে বাকি ছিল না; পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কী করতে চাইছে। বাঙালিও মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিল, ক্রিকেটমাঠ নয়, পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধের মাঠে লড়াইয়ে নামার। ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার পর বাঙালি যুদ্ধের প্রস্তুতি নিল। তার আগে পাক ক্রিকেটারদের উদ্দেশে একমাত্র বাঙালি ক্রিকেটার এ এস এম রকিবুল হাসান হোটেল থেকে বিদায় নেয়ার সময় বললেন, ‘জানি না। আর দেখা হবে কি না। তবে যদি দেখা হয়, তাহলে নতুন পাসপোর্ট হাতে নিয়েই দেখা হবে।’

ফ্ল্যাশ ফরোয়ার্ড, গত শতাব্দীর আশির দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা পাকিস্তান গিয়েছিলেন। রকিবুল হাসানও গিয়েছিলেন। কিন্তু সত্যিই আলাদা পাসপোর্ট নিয়ে পা রেখেছিলেন পাকিস্তানের মাটিতে। হাতে বাংলাদেশের সবুজ পাসপোর্ট। তারপর বাংলাদেশের মাটিতে ওয়ানডে-টেস্ট-টি-টোয়েন্টি অনেক ম্যাচই খেলতে গেছে। কিন্তু এবারের মতো এত দোলাচলে দুলতে দুলতে আগে কখনো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পাকিস্তান যায়নি। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এখন পাকিস্তানে। লাখ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে পাকিস্তানের মাটিতে। লাহোরের গাদ্দাফিা স্টেডিয়ামে এবং তার আশপাশে।

যে পতাকার জন্য বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছে, প্রাণ দিতে হয়েছে, সম্ভ্রম দিতে হয়েছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের সহযোগীদের হাতে এবার সেই পাকিস্তানের বিশেষ বাহিনীকে পাহারা দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস পাকিস্তানিদের জন্য। একদিন যারা জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করেছিল বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে, বঙ্গবন্ধুকে কারার অন্ধকারে রুখে দিতে, সেই তাদেরই আজ বঙ্গবন্ধুর দেশের ক্রিকেটারদের ভিভিআইপির মর্যাদায় তিন স্তরের নিরাপত্তা দিয়েও নিশ্চিত থাকতে পারছে না! সেটা ক্রিকেটের কারণে। একদিন যারা মুখে বলতেন, ‘ভাত খাওয়া বাঙালি আবার কী ক্রিকেট খেলবে?’ সেই বাঙালিদের সৌজন্যে নিজেদের দেশের ক্রিকেটীয় অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সবকিছু করছেন পাক ক্রিকেট কর্তারা।

Advertisement

আসলে ক্রিকেট শুধু একটা খেলা নয়। ক্রিকেট একটা দর্শন। ক্রিকেট ইতিহাস-ভুগোল-রাষ্ট্র-সমাজ সবকিছুকে বুকে নিয়ে চলে। যারা শুধু ক্রিকেটকে স্কোরকার্ডে লেখা সংখ্যা আর জয়-পরাজয় দিয়ে বিবেচনা করেন, আসলে ক্রিকেট তারা কতটা বোঝেন? বিখ্যাত এক ক্যারিবীয় ক্রিকেট সাহিত্যিক অনেকদিন আগে কথাটা বলেছিলেন, ‘আসলে ক্রিকেটের তারা কী বোঝেন, যারা শুধুই ক্রিকেট বোঝেন!’

পাকিস্তানি বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা পাহারা দিচ্ছেন! স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর আগে বাঙালির এই অর্জনকে কীভাবে দেখবেন আপনি? সেটা ক্রিকেটের সৌজন্য। বাঙালির এটাও বড় এক বিজয়।

লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।

এইচআর/বিএ/এমএস

Advertisement