মতামত

বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতি-প্রতিরোধী ব্যবস্থা

‘ব্যাংকের টাকা মেরে কানাডায় বাড়ি’ শিরোনামে দৈনিক সমকালে একটি সংবাদ হয় গত ডিসেম্বরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল হান্নান রতন রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক থেকে বিপুল অংকের টাকা ঋণ হিসেবে নিয়ে ব্যবসা বাণিজ্য কিছু না করে কানাডায় পালিয়েছেন।

Advertisement

ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশে বিত্তবৈভব গড়ে তোলা রতনের আলোচনা চলার সময়ই আরেক পিলে চমকানো খবর এর। বাংলাদেশের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৩৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে নিয়ে চম্পট দিয়েছেন প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার নামের এক ব্যক্তি। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, জানা গেল, রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কানাডায় ‘আত্মগোপন’ করে আছেন স্ক্র্যাপ (জাহাজ ভাঙা) ব্যবসায়ী গাজী বেলায়েত হোসেন মিঠু ওরফে জি বি হোসেন। তিনি ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।

হাজার ও শত কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দেয়ার এসব খবরের মাঝেই দুর্নীতির ধারণা সূচক নিয়ে (করাপশন পারসেপশন ইনডেক্স-সিপিআই ২০১৯) গত বৃহস্পতিবার হাজির হল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ। বলা হয়েছে, বাংলাদেশের স্কোর ২৬, যা গত বছরের তুলনায় অপরিবর্তিত রয়েছে। এই তালিকার ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬তম, যা ২০১৮ এর তুলনায় ৩ ধাপ উন্নতি। তালিকায় নিচের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম, যা গত বছরের তুলনায় একধাপ উন্নতি। সূচক অনুযায়ী ২০১৯ সালে বাংলাদেশের অবস্থান সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সিপিআই ২০১৯ অনুযায়ী, ১০০ এর মধ্যে গড় স্কোর ৪৩। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশের স্কোর ২৬ হওয়ায় দুর্নীতির ব্যাপকতা এখনও উদ্বেগজনক। সূচকে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবে তা সন্তোষজনক নয়।’

এই যে, বাংলাদেশের জনগণের টাকা মেরে কিছু লোক বিদেশ চলে যাচ্ছে, এতে আনেকে হাসি ঠাট্টা করছেন যে, বাংলাদেশ দুর্নীতিবাজ রপ্তানি করতে শুরু করেছে। কিন্তু বিষয়টি আসলে ঠাট্টা হিসেবে দেখার সুযোগ আর নেই। সাধারণ ও প্রান্তিক মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ চুরি করে বিদেশে গিয়ে বাড়ি গাড়ি করা মোটেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য ইতিবাচক নয়।

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী বলছেন, উদ্যোগ নিচ্ছেন, কিন্তু দুর্নীতি কমানোটা সহজ মনে হচ্ছেনা। ব্যক্তির লোভ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি সর্বত্র নৈতিকতা বিসর্জনের সংস্কৃতি অনুশীলনের বেপরোয়া মনোভাব এত বিস্তৃত হলে একা একজন প্রধানমন্ত্রী সফল হতে পারবেন না।

আমরা এমন এক সমাজ সৃষ্টি করেছি যে, সাধারণভাবে সমাজের মানুষও এ ধরনের দাগি ব্যক্তিদের প্রত্যাখ্যান বা নির্বাসিত না করে বরং সাদরে-সমাদরে মাথায় তুলে রাখে, তাদের যাত্রাপথে পুষ্পবৃষ্টিও করে। পুরো সমাজ এখন সংকীর্ণ পচনশীল স্বার্থপরতায় আপ্লুত।তাহলে করণীয় কী?

প্রধামন্ত্রীর স্ব-উদ্যোগে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্ত বিরোধী অভিযান পরিচালিত হতে দেখেছি গত বছরের শেষ দিকে। সেই অভিযানে নিজ দলের বড় পান্ডাদেরও ছাড় দেননি তিনি। এখন সেই অভিযান আর চলছে না। হয়তো কোন এক সময় আবার শুরু হবে। কিন্তু এটি অভিযান চালু বা বন্ধ করার বিষয় নয়। আমাদের আসলে দুর্নীতি কমানোর পথ জানাটাই এখন জরুরি। সরকারি ও আধা-সরকারি ক্ষেত্র মিলিয়ে দুর্নীতি নিবারণ আইন ও দণ্ডবিধির সংশ্লিষ্ট ধারাগুলো বেশ কঠিন হলেও সুফল আসছে না।

একটা বড় কারণ দুর্নীতি অভিযোগ দায়ের হচ্ছে কম, আর যাও হচ্ছে সেখানে শাস্তি হচ্ছে আরও কম। কত দিন বিচার চলে বা শাস্তির বহর কতটা, সে বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যই পাওয়া যায় না। যারা দুর্নীতি করে তাদের কাছে হিসেবটা পরিষ্কার। তারা বেশ জানে- দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে ভাল লাভ করা যায়, ধরা পড়ার ঝুঁকি কম। যে দু’একটা সাজা হয় তার প্রভাবও নেই সেভাবে। দুর্নীতির শাস্তি যদি অন্যায় পথে অর্জিত আয়ের চেয়ে বেশি হয়, তবে দুর্নীতি কমতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে হয় উল্টোটা। শাস্তির চেয়ে এখানে আয় বেশি। আর এ কারণেই দুর্নীতি উৎসাহিত হয়। ফৌজদারি অপরাধের বিচার ব্যবস্থায় ত্রুটির ফলেই সাধারণ ভাবে দুর্নীতির মাত্রা বেশি হয়।

Advertisement

সরকারকে সে জায়গায় আঘাত করতে হয়। একটি দুর্নীতি দমন কমিশন আছে, কিন্তু সরকারি-বেসরকারি দুর্নীতি দমনে সাফল্য তেমন নেই। মানুষের একটি সাধারণ ধারণা– দুদক বড় খেলোয়াড়দের বাদ দিয়ে চুনোপুটিদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আরেকটি ধারণা হল ব্যক্তি খাতে দুর্নীতিবাজদের ব্যাপারে যাও কিছুটা উৎসাহ আছে, আমলাতন্ত্রের ভেতরকার দুর্নীতির ব্যাপারে দুদক পুরোই নির্লিপ্ত। এই জনধারণা ভাঙ্গার দায়িত্ব দুদকেরই।

সরকারি কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করার আগে সরকারি অনুমতি নেওয়ার নিয়মটি নিয়ে মানুষের আপত্তি আছে। যারা এই নিয়ম যারা করেছেন সেই জনপ্রতিনিধিদের কিন্তু কোন অবস্থাতেই ছাড় দেয় না আমলাতন্ত্র। তারা কেন এমন একটি বিধান করলেন সেটা তারাই ভাল বলতে পারবেন।

বড় আকারের দুর্নীতি কমাতে বড় পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে জনগণের যে সেবা প্রাপ্য সেই সেবা পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সংঘটিত দুর্নীতি আটকানো জরুরি কাজ। সরকারি কর্মকর্তাদের ডিস্ক্রিশনারি পাওয়ার বা একচেটিয়া কর্তৃত্ব এবং যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার না কমালে সরকারি-আধা সরকারি দপ্তরে জনগণ কোন সেবাই পাবেনা।

অভিযান হোক, আইন হোক, আলাপ হোক– কিছুই আসবে যাবে না। একটা বিশ্বাসযোগ্য দুর্নীতি-প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি না করতে পারলে দুর্নীতির প্রকোপ কমানো সম্ভব নয়। আর তা করা হবে কি না, সেটা আসলে বড় রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রশ্ন।

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/জেআইএম