এ সময়ের জনপ্রিয় তরুণ লেখক, কবি ও নির্মাতা সাদাত হোসাইন। একের পর এক গল্প, উপন্যাস ও কবিতা দিয়ে জয় করেছেনে অগণিত পাঠকের হৃদয়। দেশের গণ্ডি পেরিয়েও জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছেন তরুণ স্বপ্নবাজ মানুষটি। পেয়েছেন একাধিক অ্যাওয়ার্ড ও সম্মাননা। পাশাপাশি নির্মাণ করেছেন তথ্যচিত্র, নাটক ও পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্রও। আসছে বইমেলা উপলক্ষে ব্যস্ততম এ লেখক সময় বের করে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক ও লেখক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—
Advertisement
এবারের বইমেলায় নতুন কয়টি বই আসছে আপনার?সাদাত হোসাইন: চারটি। বইমেলা উপলক্ষেই এসেছে ‘মেঘেদের দিন’। কিন্তু বইটি যেহেতু অনেক আগেই প্রস্তুত করা হয়ে গিয়েছিল এবং তুমুল পাঠক চাহিদা ছিল, ফলে অন্যপ্রকাশ ডিসেম্বরের মাঝামাঝিই বইটি বাজারে নিয়ে আসে। এছাড়া বইমেলায় আসছে আমার দীর্ঘ উপন্যাস ‘অর্ধবৃত্ত’। প্রকাশ করছে অন্যধারা। উপন্যাসটি নিয়ে আমি খুব এক্সাইটেড। কারণ শহুরে জীবন নিয়ে আমি খুব একটা বেশি লিখিনি। আমার লেখাগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাম প্রাধান্য পেয়েছে। তবে এ উপন্যাসটি পুরোপুরি শহুরে গল্প। আমি এমনকি একবার এটির নাম দিতে চেয়েছিলাম শহুরে শরীরও। উপন্যাসটি সমসাময়িক নাগরিক জীবনে নানা সমীকরণে সম্পর্কের যে সংযোগ, সেটি কী করে সংকটও তৈরি করে, নানাবিধ সমীকরণে জটিল হতে থাকে, তার একটা রুদ্ধশ্বাস গল্প। আরেকটি বিষয়ও এসেছে, নারী-পুরুষের সম্পর্কে শরীর না মন, কোনটি মূল প্রভাবক, এই আলোচনাও প্রবলভাবে এসেছে। এখানে নানা পার্সপেক্টিভ থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এটি অনেক অনেক সমীকরণের গল্প, যেখানে অসম প্রেম, অননুমেয় বাস্তবতা, প্রেম ও প্রত্যাখ্যান, জিঘাংসা, মমতা এবং একটি খুন, যার রুদ্ধশ্বাস রহস্যময়তারও আখ্যান। উপন্যাসটি নিয়ে আমি প্রচণ্ড আশাবাদী। অন্যধারা থেকে উপন্যাসটির পাশাপাশি আসছে কবিতার বই ‘তোমাকে দেখার অসুখ’। বই দুটি পাওয়া যাবে অন্যধারার ৫৯৯-৬০২ নম্বর স্টলে। আর অর্ধবৃত্তের অনলাইন প্রি অর্ডার শুরু হয়ে গেছে রকমারিসহ সব অনলাইন শপে।
পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ের খুবই সংবেদনশীল ইস্যু ধর্ষণ ও বিচার নিয়ে একটা উপন্যাস আসছে অন্যপ্রকাশ থেকে। উপন্যাসের নাম ‘মরণোত্তম’। আমার ধারণা, উপন্যাসটি আমাদের প্রচলিত বাস্তবতা, অপরাধ-অপরাধী, ধর্ষণ-ধর্ষক, বিচারহীনতা এবং প্রতিবাদের অসাড়তা কিংবা অক্ষমতা নিয়ে নতুন এক ভাবনা তৈরি করবে। আমি এটিকে বলছি, চোখে আঙুল ঠেসে দেওয়া। টিনের চশমাগুলো খুলে ফেলার চেষ্টা। মেঘেদের দিনসহ উপন্যাসটি অন্যপ্রকাশের ২১ নম্বর প্যাভিলিয়নে পাওয়া যাবে।
এ বছরই মনে হয় প্রথম একসঙ্গে চারটি নতুন বই আসছে?সাদাত হোসাইন: হ্যাঁ। এ বছরই প্রথম। এর আগে প্রতিবছর বইমেলা উপলক্ষে একটি বই প্রকাশ হতো। তবে বছরের বিভিন্ন সময়েও বই প্রকাশ হতো।
Advertisement
বরাবরই আপনার পাঠকসংখ্যা ঈর্ষণীয়। তবুও বইয়ের সংখ্যা বেশি হওয়ায় বিক্রিতে কোন প্রভাব পড়বে কি? সাদাত হোসাইন: দেখা যাক। এর আগে তো এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। এটা এক ধরনের এক্সপেরিমেন্টও বলতে পারেন। তবে আগে দেখতাম, পাঠক প্রায়ই খুব আক্ষেপ করছেন যে, আমি কেন প্রতি বইমেলায় একটা মাত্র বই লিখি। তারা আরও আরও বেশি বই চান। এবার দেখা যাক, সত্যি সত্যিই তারা চান? না-কি স্রেফ কথার কথাই ছিলো। হা হা হা। জোকস এপার্ট। আমার বিশ্বাস, যত বই-ই হোক, আমার যারা পাঠক, যারা আমার লেখা ভালোবাসেন, তারা নিশ্চয়ই খুব আগ্রহ নিয়ে সবগুলো বই-ই সংগ্রহ করবেন। এখনো পর্যন্ত পাঠকের যে আগ্রহ আমি দেখেছি, তাতে এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
তিনটি উপন্যাসের মাঝে একটি কবিতার বই। শুনেছি কবিতার বই বিক্রি কম হয়। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?সাদাত হোসাইন: আমার অভিজ্ঞতা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। অনেককেই বলতে শুনি, কন্টেন্ট না, কেবল প্রচারণার কারণেই নাকি আজকালকার জনপ্রিয় তরুণ লেখকদের বই বিক্রি হচ্ছে।
এ কথার সাথে তীব্র বৈপরীত্য প্রদর্শন করেছে আমার গত দুটি কবিতার বই। বিশেষ করে ‘কাজল চোখের মেয়ে’। আমি বলতে গেলে এটার কোনো প্রচারণাই করিনি। কিন্তু কিছুদিন আগে প্রকাশক এসে যখন গত একবছরে এই বই বিক্রির হিসেব দিলেন, আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ উপন্যাসের বিষয়ে আমি সবখানেই খুব সরব থাকি, প্রত্যাশাও বেশি থাকে। ফলে বিক্রি সম্পর্কেও একটা স্পষ্ট ধারণা থাকে। কিন্তু আমার কবিতার বইয়ের ক্ষেত্রে পাঠক নীরবে নিভৃতে যে সাড়া দেখিয়েছে, তা আমার কাছে বিস্ময়কর!
এবার ‘তোমাকে দেখার অসুখ’ নিয়ে পাঠকের যে আগ্রহ লক্ষ্য করছি, তাতে আমার ধারণা এটিও অসাধারণ সাড়া ফেলবে আমার সেই বিশাল সংখ্যক নীরব পাঠকের মধ্যে। এ পাঠক শ্রেণি ফেসবুকে খুব সরব নন। কিন্তু নীরবে প্রবল আগ্রহ নিয়ে তারা আমার বইয়ের অপেক্ষায় থাকেন। এটি আমার জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা। এ বিশাল অংশের নীরব পাঠক সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না!
Advertisement
বইমেলার আগেই ‘মেঘেদের দিন’ উপন্যাসের তৃতীয় মুদ্রণ নিয়ে কিছু বলবেন কি?সাদাত হোসাইন: হা হা হা। কী বলবো? এটা হচ্ছে অন্ধের হাতি দর্শনের মতো ব্যাপার। আপনি যা কখনো এক্সপেরিয়েন্স করেননি, তা সম্পর্কে আপনার ধারণা অনুমান কর্তৃক নির্ধারিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে বড় বড় সব প্রকাশনীই তাদের বইমেলার অনেক বই ছেপে ফেলে। কারণ জানুয়ারিজুড়ে তাদের কিউতে আরও অসংখ্য বই থাকে। সেসব বই একসাথে একই সময়ে ছাপা সম্ভব? সম্ভব নয়। ফলে এটি অনুশীলিত একটি প্রক্রিয়া যে, ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে যেসব বই ছাপা হয়, তা মূলত বইমেলার বই-ই। যেহেতু আমার এ বইটি অন্যদিন ঈদ সংখ্যায় আরও বছর দুই আগেই ছাপা হয়েছিল, ফলে বইটি রেডি হয়েই ছিল। আর এ কারণে জানুয়ারির প্রেসার কমাতেই আরও অনেক বইয়ের সাথে এটিও ছেপে ফেলা হয়েছে ডিসেম্বরে। আমি উপরেই বলেছি, যেহেতু প্রবল পাঠক চাহিদা ছিল, ফলে আমরা বইটা আগেই বাজারে নিয়ে আসি। তাছাড়া এটাও মাথায় ছিল যে, বইমেলায় একসাথে এতোগুলো বই না এনে একটু আগে ছেড়ে দিলে পাঠকের ওপর বইমেলার প্রেসারটাও একটু কম পড়বে। খুব সহজ সাধারণ একটা বিষয়। এটাকে শুধু শুধু উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিংবা বড় পরিসরে বইয়ের প্রিন্টিং প্রসেস সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষগুলো রং চড়িয়েছে।
বইটি যেহেতু ডিসেম্বরে প্রকাশ হয়েছে, তাই প্রকাশকাল ডিসেম্বর ২০১৯ দেওয়া যেত কি-না?সাদাত হোসাইন: এ সম্পর্কে আগেই উত্তর দেয়া হয়েছে। তারপরও আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, একটি দৈনিক পত্রিকা যখন ২ তারিখে পাঠকের হাতে যায়, সেটিতে ২ তারিখ কেন লেখা থাকে? কেন ২ তারিখের আগের দিন ১ তারিখ লেখা থাকে না? কারণ পত্রিকাটি কিন্তু ২ তারিখে ছাপা হয়নি। হয়েছে ১ তারিখে। তাই না? এমনকি পত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্রগুলো আরও দুয়েকদিন আগেই ছাপা হয়। কেন? এখন একটা পত্রিকা বাজারে আনতে যেখানে সেলাই, বাঁধাই, শুকানোসহ বইতে প্রয়োজন হয় এমন আরও অসংখ্য প্রসেসের কিছুই লাগে না, সেখানেও দুয়েকদিন আগে ছেপে পরের ডেট থাকে, সেখানে বইয়ের ক্ষেত্রে বইমেলার বই যে আগে ছাপা হবে, সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? এটা কম-বেশি সব প্রকাশনীই করে।
অন্যপ্রকাশও বইমেলার একুশটি বই ডিসেম্বরেই ছেপে ফেলেছে। এর অনেকগুলো বাজারেও চলে এসেছে। শুধু অন্যপ্রকাশ একাই নয়, আরও অনেক বড় বড় প্রকাশনী, যারা বইমেলায় বিশাল সংখ্যক বই ছাপেন, তারা বইমেলার কিছু কিছু বই ডিসেম্বরেই ছেপে ফেলেছেন বইমেলার ডেট দিয়েই। অনেক বই বাজারেও চলে এসেছে। এটা খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা নিয়ে অযথা ইস্যু তৈরি করা হয় এ প্রসেস সম্পর্কে জানার অজ্ঞতা কিংবা মূর্খতা কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বুঝেও না বোঝার ভান ধরে যুক্তিহীন অপপ্রচারের মানসিকতায়।
‘মেঘেদের দিন’ ও ‘মরণোত্তম’ আগেই অন্যদিনের ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে পাঠকের আগ্রহ বাড়বে না কমবে?সাদাত হোসাইন: ঈদ সংখ্যা আগে যেমন পাঠক খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ত, পরিবর্তিত সমসাময়িক বাস্তবতায় সেটি আর হয় না। ফলে আমার ধারণা, উপন্যাস দুটি খুব বেশি পাঠক পড়েননি। এ কারণে আগ্রহের কমতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমার বিশ্বাস, বইমেলায় চারটি বই-ই পাঠক আগ্রহ নিয়ে কিনবেন।
বইমেলা উপলক্ষে পাঠকদের উদ্দেশে কিছু বলুন—সাদাত হোসাইন: বই পড়ুন। এ সময়ে বই পড়াটা খুব খুব জরুরি। বিশেষ করে বয়সে তরুণ বাবা-মা কিংবা অভিভাবকদের বলবো, আপনার সন্তানকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলুন। পৃথিবী যতই বদলাক, যতই টেকনোলজি উন্নত হোক, রিক্রিয়েশনের বিকল্প মাধ্যম তৈরি হোক, তাতেও বইয়ের শ্রেষ্ঠত্ব এতটুকুও কমবে না। ফলে বইয়ের কাছাকাছি থাকতে হবে। রাখতে হবে। সবসময়, সবাইকে।
এসইউ/এমএস