একসময় দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের সুনাম কুড়ালেও এবার উল্টোপিঠ দেখছে। বিদেশি শিক্ষার্থীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানসম্মত শিক্ষার অভাব, অধিক ব্যয়, অবকাঠামো সংকট ও নিরাপত্তার অভাব এক্ষেত্রে প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র ইতিবাচক। তারাই পারছে কেবল শিক্ষার্থী ধরে রাখতে। অন্যদিকে শিক্ষার্থীর হার বাড়ছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। নানা সুযোগ-সুবিধার কারণে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশিরা আগ্রহী হচ্ছেন বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
Advertisement
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রকাশিত ‘৪৫তম বার্ষিক প্রতিবেদন-২০১৮’-এ উঠে এসেছে এমন চিত্র। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীর হার হ্রাসের কথা বলা হলেও প্রতিবেদনটি জানাচ্ছে, বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে যে ডিজিটালাইজেশন হয়েছে, তার ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তির কল্যাণে এখানকার কোর্স-কারিকুলাম ও সিলেবাস ইত্যাদি দেখে এ দেশে পড়ার জন্য উৎসাহী হচ্ছেন।
ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৯১টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৩৭টিতে মোট ৩৩টি দেশের শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন। ২০১৭ সালে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৯৭৭ জন। কিন্তু ২০১৮ সালে কমে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৮৬ জনে। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় পরের বছর শিক্ষার্থী কমেছে ৫৯১ জন। যদিও এক্ষেত্রে প্রথম সারির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র ভিন্ন, তারাই ধরে রাখতে পারছে বিদেশি শিক্ষার্থী, অন্যরা এক্ষেত্রে হতাশার বৃত্তে পড়ছে।
২০১৮ সালে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, চীন, জাপান, সৌদি আরব, ইয়েমেন, ফিলিস্তিন, গাম্বিয়া, মরক্কো, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, উগান্ডা, জিম্বাবুয়ে, সিয়েরালিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান, সোমালিয়া, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, বাহরাইন, লাইবেরিয়া, জাম্বিয়া, জিবুতি, মিয়ানমার, কেনিয়া, দক্ষিণ সুদান এবং যুক্তরাজ্য মিলিয়ে মোট ৩৩টি দেশের শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে আসেন।
Advertisement
ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগে প্রায় প্রতিবছর বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও ২০১৮ শিক্ষাবর্ষে এসে এ সংখ্যা কমেছে। বেশ কিছু শিক্ষার্থী তাদের ক্রেডিট শেষ করে নিজ দেশে ফিরে গেছেন।
বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমার পেছনে অন্যান্য কারণের পাশাপাশি এটিও উল্লেখযোগ্য বলে মনে হচ্ছে শিক্ষাবিদদের।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক ডিজিটালাইজেশন হয়েছে। ফলে বিদেশি শিক্ষার্থীরা তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির (আইসিটি) কল্যাণে বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে উচ্চশিক্ষার কোর্স-কারিকুলাম, সিলেবাস ইত্যাদি দেখে বাংলাদেশে পড়ার জন্য উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
বেশ কয়েকটি উন্নত দেশ- যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, চীন ও অস্ট্রেলিয়া থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছেন বাংলাদেশে। সে কারণে বহির্বিশ্বে একদিকে যেমন বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হচ্ছে, অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের হারও বাড়ছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার গুণগতমান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে প্রতিবেদনে পরামর্শ দেয় ইউজিসি।
Advertisement
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা সমিতির সভাপতি শেখ কবির জাগো নিউজকে বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীরা পড়তে আগ্রহী হলেও তাদের সব সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বিধায় এ সংখ্যা কমে যাচ্ছে, তারপরও আমাদের অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থী পড়ছেন। বহির্বিশ্বের যেসব শিক্ষার্থী পড়তে আসছেন। তাদের আবাসিক সুবিধা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না বিধায় এ সংখ্যা বাড়ছে না, বরং কমে যাচ্ছে। তবে আমরা চাই অধিক সংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী পড়তে আসবেন। এ জন্য সরকারিভাবে সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আহ্বান জানাই।
এদিকে ইউজিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত দুই বছরে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৭ সালে দেশের ২৩টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৪৬১, যা ২০১৮ সালে এসে ৮০৪-এ দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় পরের বছর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী বেড়ে গেছে ৩৪৩ জন। এর আগে ২০১৬ সালে ৩৫৫ জন, ২০১৫ সালে ৫৯৩ জন, ২০১৪ সালে ৪৩২ জন, ২০১৩ সালে ৩২৬ জন, ২০১২ সালে ৫২৫ জন, ২০১১ সালে ২১০ জন এবং ২০১০ সালে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৫৯ জন।
জানতে চাইলে শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়ন কমিটির আহ্বায়ক শিক্ষাবিদ ড. একরামুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশে বহির্বিশ্বের শিক্ষার্থীরা পড়তে আসছেন, এটি আমাদের জন্য ইতিবাচক বিষয়। এতে করে বিদেশি অর্থ উপার্জন হচ্ছে, তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মানসম্মত শিক্ষা, আবাসন সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম না হওয়ায় তাদের বিদেশি শিক্ষার্থী হ্রাস পাচ্ছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে পাশ্ববর্তী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকাসহ বিভিন্ন দেশে শিক্ষার খরচ কম। এ কারণে তারা এদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বেসরকারি কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে আবার উচ্চশিক্ষা প্রদানের নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে ফেলেছেন অনেকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা সুবিধা থাকায় সেখানে পড়তে আগ্রহী হচ্ছেন বিদেশি শিক্ষার্থীরা।
বিদেশি শিক্ষার্থী বাড়াতে পরামর্শ দিয়ে এ শিক্ষাবিদ বলেন, শিক্ষার মান বাড়াতে হবে, শুধু আসবাবপত্র আর চাকচিক্যময় ভবন বানালে শিক্ষার মান বাড়বে না। এজন্য দক্ষ শিক্ষক ও যুগোপযোগী শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা বৃদ্ধি, এক্সট্রা কারিকুলাম সুবিধাসহ উচ্চশিক্ষার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
এমএইচএম/এইচএ/জেআইএম