হারকিউলিসের কথা নিশ্চয়ই আপনি ভুলে যাননি। টেলিভিশনের জনপ্রিয় ইংলিশ সিরিয়াল নয়; বরং কথিত ধর্ষণ মামলার একাধিক আসামি অথবা অভিযুক্তকে গুলি করে হত্যার পরে তার গলায় চিরকুটে লেখা ছিল যে হারকিউলিসের কথা, সেটি নিয়ে সারা দেশে যেভাবে তোলপাড় শুরু হয়েছিল, তাতে ওই ঘটনাগুলোর পরে দেশ থেকে ধর্ষণ শব্দটির বিদায় নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ধর্ষণ কি বন্ধ হয়েছে? বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হওয়ার রেশ না কাটতেই রাজধানীর কামাঙ্গীরচর ও ভাটারায় দুই কিশোরীর গণধর্ষণের শিকার হওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে। দেশের আনাচে-কানাচে এসব ঘটনা নিয়মিতই ঘটে, যার সবগুলো গণামধ্যমে আসে না। সব ঘটনা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড়ও ওঠে না।
Advertisement
আরেকটু ফ্লাশব্যাকে গিয়ে আপনি স্মরণ করতে পারেন দেশের বিভিন্ন স্থানে পরপর অনেকগুলো শিশু ধর্ষণের পরে বেশ কয়েকজন আসামি বা প্রাথমিকভাবে অভিযুক্তকে (আদালতে প্রমাণিত নয়) ক্রসফায়ারে হত্যা করা করা হয়েছিল। তাতেও কি দেশ থেকে শিশু ধর্ষণ নির্মূল হয়েছিল? যদি না হয়, তাহলে এখন যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়ার দাবি তুলছেন, তারা কি নিশ্চিত যে, মজনু নামে গ্রেপ্তার ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ যদি আদালতে প্রমাণিতও হয় এবং ধর্ষণবিরোধী আইন সংশোধন করে যদি তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, তাহলে দেশে আর কোনো নারী-শিশু ধর্ষণের শিকার হবে না—কেউ কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন?
দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, আদালতে প্রমাণিত হওয়ার আগেই আমরা যখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বরাতে কাউকে ধর্ষক বলে সাব্যস্ত করি এবং গণমাধ্যমও যখন সেই স্রোতে গা ভাষায়, তখন প্রচলিত বিচারব্যবস্থার কোনো প্রয়োজনীয়তা অবশিষ্ট থাকে কি না? তৃতীয় প্রশ্ন, আমাদের দেশে ধর্ষণ মামলার যে বিচার প্রক্রিয়া সেখানে অপরাধ প্রমাণের সুযোগ কতটা আছে এবং এই ব্যবস্থায় কারো ভিকটিমাইজড হয়ে যাওয়ার শঙ্কা থেকে যায় কি না? চতুর্থ প্রশ্ন, উন্নত এবং সভ্য দেশ বলে পরিচিত রাষ্ট্রের কেন ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটে? সেসব দেশে তো আইনের শাসন রয়েছে। মানবিক মূল্যবোধ এবং মানুষের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধও বেশ গভীর। কিন্তু তারপরও কেন সভ্য দেশেও এই অসভ্য কাজ হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় মজনু নামে যে লোকটিকে গ্রেপ্তার করা হলো, তিনি আসলেই ধর্ষক কি না, সেটি নিয়ে কেন সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষ সন্দেহ পোষণ করছে। কেন অনেকের কাছে মনে হচ্ছে যে, এটা একধরনের ‘জজমিয়া’ নাটক? মানুষের এই অনাস্থা বা অবিশ্বাস কেন? কেন তাদের কাছে এটা সেই মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পের মতোই মনে হচ্ছে?
এই প্রসঙ্গে আমাদের এ প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই যে, কুমিল্লায় কলেজছাত্রী সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের পর হত্যায় জড়িত/জড়িতরা এখনও কেন গ্রেপ্তার হলো না বা যদি এ ঘটনায় সত্যিই কারো বিচার হয়ে থাকে, সেটি কেন দেশের মানুষ জানতে পারলো না? কেন এই ঘটনাটিকে অতি স্পর্শকাতর বলে বিবেচনা করা হয়? ঘটনাটি স্পর্শকাতর স্থানে হয়েছিল বলে? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটিও ওই স্পর্শকাতর স্থানের খুব কাছেই ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। কিন্তু এই ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে তৎপরতা দেখা গেছে, তনুর ক্ষেত্রে সেটি কেন অনুপস্থিত?
Advertisement
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের একটি বিধান নিয়েও আমাদের প্রশ্ন তোলার সময় হয়েছে। বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। তবে ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির মৃত্যু হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। আবার এই আইনেই বলা হয়েছে, যদি কোনো নারী বা শিশু সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এবং এর ফলে তার মৃত্যু হয় বা তিনি আহত হন, তা হলে ওই সংঘবদ্ধ দলের প্রত্যেককে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যাবে। এই একই আইনে বলা হয়েছে, যদি পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন কোনো নারী ধর্ষণের শিকার হন, তা হলে যাদের হেফাজতে থাকাকালীন ওই ঘটনা ঘটেছে, তাদের সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড হবে। একই আইনে একই অপরাধের শাস্তি সাধারণ মানুষের জন্য একরকম আর পুলিশের জন্য আরেক রকম হবে কেন? বরং পুলিশি হেফাজতে কেউ ধর্ষণের শিকার হলে তার শাস্তি হওয়া উচিত আরও অনেক বেশি। কারণ নারী ও শিশুকে যাদের সুরক্ষা দেয়ার কথা, সেই সুরক্ষিত স্থানেই যদি কেউ পাশবিকতার শিকার হন, সেখানে শুধু ব্যক্তির অপরাধের কারণেই নয়, বরং পুলিশ বাহিনীর মতো একটি প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থতার বিচারও হতে হবে।
এসব কারণে এখন ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি উঠেছে। তা সেটি যে ধরনের অর্থাৎ একক অথবা সংঘবদ্ধ কিংবা পুলিশ হেফাজতে—যাই হোক না কেন। এ দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উত্তাল। কিন্তু এক্ষেত্রেও যে প্রশ্নটি সামনে আসে তা হলো, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেই কি ধর্ষণ পুরোপুরি নির্মূল হবে? কেননা, ধর্ষণের বহু আসামি বা অভিযুক্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। তারপরও ধর্ষণ বন্ধ হয়নি। তাছাড়া সারা বিশ্বের উন্নত ও সভ্য রাষ্ট্রগুলো এখন ধীরে ধীরে মৃত্যুদণ্ডের বিধান থেকে সরে এসেছে। বলা হয়, একজন অপরাধীর যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়, সেটিও অনেক বড় শাস্তি। একজন মানুষ পুরো পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা একটি জায়গায় পরাধীন হয়ে আটকে থাকে, শাস্তি হিসেবে এটিও ভয়াবহ। কিন্তু তারপরও অপরাধীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য মৃত্যুদণ্ডের মতো ক্যাপিটাল পানিশমেন্টের পক্ষেও জনমত আছে।
অনেকে মনে করেন মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হলে অন্তত সমাজের উঁচু পর্যায়ে ধর্ষণের ঘটনা কমবে। এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে, সমাজের নিচু তলার চেয়ে উঁচু তলায় সংঘটিত নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিষয়গুলো কম প্রকাশিত হয়। অনেক সময় ভিকটিম সামাজিক অবস্থান ও মানসম্মানের ভয়ে বিষয়গুলো চেপে যান। অনেক সময় পরিবারও চেপে যায় বা এসব ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিরা সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রভাবশালী হওয়ায় অনেক সময় ভুক্তভোগীরা এসব নিয়ে কথা বলার সাহস করেন না। অনেক সময় এসব ঘটনায় থানা-পুলিশ হলেও সেটি জানাজানি হবার আগেই ‘পুলিশের মধ্যস্থতায়’ মীমাংসা হয়ে যায়। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের অবিশ্বাস, অনাস্থা ও সন্দেহের মাত্রা এতই প্রবল হয়েছে যে, তারা সত্যিকারের অপরাধীকে ধরলেও মানুষ তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে; যা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ধর্ষণের আসামি মজনুকে গ্রেপ্তারের পরে।
অতীতে অনেক ঘটনাই আলোর মুখ দেখেনি, দেখলেও তার বিচার হয়নি। অনেক সময় ধর্ষণ প্রমাণ করাও কঠিন। ঘটনার অনেক দেরিতে মেডিকেল পরীক্ষা এবং অনেক সময় পরিবারের অসচেতনতার (যেমন ঘটনার পরে ভিকটিমকে গোসল করানো) কারণেও ধর্ষণের আলামত নষ্ট হয়। সুতরাং ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান করা হলেই যে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে এই অপরাধ পুরোপুরি নির্মূল হবে, তা চোখ বন্ধ করে বলা কঠিন। কারণ যে সমাজবাস্তবতা একজন লোককে ধর্ষক হতে উৎসাহ দেয়, সেটির পরিবর্তন করা না গেলে, পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানবিক মূল্যবোধ এবং মানুষকে মানুষ হিসেবে মর্যাদা দেয়ার শিক্ষা জোরালো করা না গেলে আাইন কঠোর থেকে কঠোরতর করেও ধর্ষণের মতো অপরাধ থেকে দেশকে বাঁচানো কঠিন।
Advertisement
লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
এইচআর/এমএস