দেশজুড়ে

মাটি ভরাট কাজের অভিজ্ঞতা নিতে দুবার বিদেশ ভ্রমণ, তেল খরচ ৯০ লাখ

>> ১০ বছর পর আবার শুরু ‘প্রান্তিক আবাসিক প্রকল্পের’ কাজ >> প্রকল্পের টাকায় দুই দফায় ১৪ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ>> দুই কোটি টাকা খরচ হলেও প্রকল্পের কোনো কাজ হয়নি>> মাটি ভরাট কাজের অভিজ্ঞতা নিতে ১৪ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ>> প্রকল্পের টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি, জ্বালানি খরচ ৯০ লাখ টাকা

Advertisement

প্রায় সাত বছর আগে রাজশাহী নগর আবাসন নিশ্চিতে ‘প্রান্তিক আবাসিক প্রকল্প’ হাতে নিয়েছিল রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে প্রকল্প ব্যয় বেড়েছে তিনগুণ। প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই ১৪ কর্মকর্তার বিদেশ ভ্রমণ ও বিলাসবহুল গাড়ির পেছনে খরচ হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। আশার কথা শিগগিরই আলোর মুখ দেখবে প্রকল্পটি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালে নগরীর গোয়ালপাড়া ও কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় ৩৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘প্রান্তিক আবাসিক এলাকা উন্নয়ন’ প্রকল্প হাতে নেয় পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (আরডিএ)। ১৪ একর জায়গায় এ প্রকল্পে ১৫০টি প্লট থাকার কথা ছিল। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই ২০১৩ সালের শেষ দিকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও আরডিএর ১৪ জন কর্মকর্তা প্রকল্পের টাকায় কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করেন। ৯৩ লাখ টাকা খরচ করে আবাসিক এলাকার জন্য মাটি ভরাট ও পরিকল্পনা কাজের অভিজ্ঞতা নিতেই বিদেশ ভ্রমণ করেন তারা।

এই ১৪ কর্মকর্তা হলেন- গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্ম-সচিব ও বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এসএম আরিফ উর রহমান, আরডিএর তখনকার চেয়ারম্যান ও বর্তমানে নৌ-পরিবহন সচিব আব্দুস সামাদ, আরডিএর ওই সময়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও বর্তমান প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ অনুবিভাগ) নাজিবুল ইসলাম, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিবের সাবেক একান্ত সচিব ও বর্তমানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) রতন চন্দ্র পণ্ডিত, গৃহায়ন অধিদপ্তরের পরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর, অর্থ মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক বেগম লুৎফুন্নেসা, মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা কোষের সাবেক ডেপুটি চিফ জালাল আহাম্মেদ, তৎকালীন গণপূর্তমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা আব্দুর রহমান আকন্দ, আরডিএর হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা বাসারুল কবির, অথরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ, নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল তারিক, সহকারী প্রকৌশলী ও প্রান্তিকের প্রকল্প পরিচালক শেখ কামরুজ্জামান, সহকারী নগর পরিকল্পক রাহেনুল ইসলাম রনি ও সহকারী এস্টেট কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম। এরই মধ্যে মাজহারুল ইসলাম অবসরে গেছেন।

Advertisement

আরডিএ সূত্র জানায়, এ প্রকল্পের টাকায় ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিলাসবহুল প্রাডো গাড়ি কেনা হয়। যার নম্বর রাজ-মেট্রো-গ-১১-০২২৩। এখন পর্যন্ত গাড়িটির কেনা, মেরামত, যাতায়াত ও জ্বালানি খরচ বাবদ ৯০ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। গাড়িটির চালক হিসেবে নিয়োগ পান নুরুল ইসলাম নামের একজন। গাড়িটি ঢাকার নিকুঞ্জ এলাকায় আরডিএর নিজস্ব রেস্ট হাউসে রয়েছে। গাড়িচালক নুরুল ইসলামও ঢাকায় থাকেন। গাড়ির তেল খরচ ও চালকের বেতন-ভাতাও প্রকল্পের টাকা থেকে দেয়া হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের গাড়িটি সাবেক চেয়ারম্যান বজলুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতেন। এখনো গাড়িটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত হয়।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিদেশ ভ্রমণ ও গাড়ি কেনার পর অদৃশ্য কারণে ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে এ প্রকল্প। ২০১৮ সালে প্রকল্পটি সংশোধন করে খরচ ধরা হয় ৪৫ কোটি ২৫ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে আবারও খরচ বাড়ানো হয়। আপাতত প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ২০২১ সাল পর্যন্ত। জমির দাম বাড়ার অজুহাতে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ৯৩ কোটি টাকা।

জানা গেছে, ৬ অক্টোবর অতিরিক্ত সচিব আনওয়ার হোসেন আরডিএর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। ৫ জানুয়ারি আরডিএর সমন্বয় সভায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর জমি অধিগ্রহণের জন্য রাজশাহীর জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছে আরডিএ কর্তৃপক্ষ।

Advertisement

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) সহকারী প্রকৌশলী শেখ কামরুজ্জামান বলেন, নানা জটিলতায় প্রকল্পটি পিছিয়ে পড়েছে। নতুন করে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। আশা করি প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন হবে।

আরডিএ চেয়ারম্যান আনওয়ার হোসেন বলেন, এ প্রকল্পের কর্মকর্তারা কেন বিদেশ ভ্রমণ করেছেন এবং তার আউটপুট কি সেটি জানা নেই আমার। আগের চেয়ারম্যান বজলুর রহমানও এ প্রকল্প নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখাননি। যোগদানের পর বিষয়টি নজরে এলে কাজ শুরু করেন। শিগগিরই জমি অধিগ্রহণ করা হবে। প্রকল্পটি পড়ে থাকায় খরচ হয়েছে। এতে লাভবান হতে পারবে না আরডিএ।

এ বিষয়ে আগের চেয়ারম্যান বজলুর রহমান বলেন, প্রকল্প এলাকার লোকজন জমি দিতে আপত্তি করায় নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। এ কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যায়নি।

অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণের প্রবণতা এক ধরনের দুর্নীতি বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলা শাখার সভাপতি আহমদ সফিউদ্দিন।

তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কর্মকর্তারা মিলে বিদেশ ভ্রমণের উৎসব করেন। এসব বন্ধ করা না গেলে আগামীতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে।

ফেরদৌস সিদ্দিকী/এএম/এমকেএইচ