মতামত

কুকুরের ভাদ্র-আশ্বিন: ধর্ষকের প্রতিদিন

ধামরাইতেও বাসে ধর্ষণ। পরে হত্যা। সিরামিক শ্রমিক মমতাকে ধর্ষণ ও হত্যার পর ধর্ষণের হোতা বাসচালক ফিরোজকে অল্প সময়েই ধরেছে পুলিশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে কুর্মিটোলায় বাসস্ট্যান্ডের কাছে ধর্ষণের ঘটনার রেশ চলতে থাকার মধ্যেই এ ঘটনা। এর আগেও এ ধরনের কয়েকটি ঘটনা গোটা দেশকে আলোড়িত করেছে। ২০১৭ সালে শোকের মাস আগস্টে টাঙ্গাইলে রুপাকে চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর বীভৎস হত্যার ঘটনা আলোচনায় ছিল অনেকদিন।

Advertisement

ধর্ষণ ও হত্যার পর তার মৃতদেহটা মধুপুর বন এলাকায় ফেলে দেয় ধর্ষকরা। ধামরাইয়ের মমতার ঘটনা কিছুটা টাঙ্গাইলের রুপার মতো। মমতা ওঠার পর বাসে আর কেউ ছিল না। পরে বাস থামিয়ে মমতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে সোহেলের হাতে কামড় দিয়ে বাস থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করেন মমতা। তখন তাকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে সোহেল। পরে লাশ জঙ্গলে ফেলে দেয়। এর মাঝেই রাজধানীর রামপুরায় ধর্ষণের শিকার হয়েছে কর্মজীবী দুই তরুণী, কামরাঙ্গীর চরে ১১ ও ১৩ বছরের দুটি শিশুসহ বিভিন্ন জায়গায় আরো অনেক।

এভাবে নতুন বছরে ধর্ষণের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও। এর আগে, বিদায়ী ২০১৯ সালকে বলা হয়েছে ধর্ষণের ‘মহাসাল’। এত অধিকসংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা এর আগে কোনো বছরে ঘটেনি। সেই ধর্ষণের ঘটনাগুলোতে জড়িতদের মধ্যে সমাজের ঘৃণ্যরা ছিল। পরিচ্ছন্ন মুখোশের মানুষগুলোও বাদ যায়নি। ২০১৯ সালে আলোচিত ঘটনা ছিল ফেনীর সোনাগাজীর নুসরাত ধর্ষণচেষ্টা এবং তাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা।

এছাড়া ছিল শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ। এর মধ্যে মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক। মোটর শ্রমিক, হাসপাতালের চিকিৎসক, সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক কর্মীসহ সব শ্রেণির মানুষের একটা অংশ এই ধর্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। ২০২০ সালে ধর্ষণের ঘটনা বাড়বে না কমবে সেটা একবাক্যে বলার সময় এখনো আসেনি। তবে, নমুনা খারাপ।

Advertisement

একের পর এক ঘটে চলা ধর্ষণের ঘটনা আমাদের সামাজিক পরিচয়ও পাল্টে দিতে বসেছে। তা শহর থেকে গ্রাম, সবখানেই গজবের মতো। বাসে, ট্রেনে, নৌকায়, ঝোপঝাড়ে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, শিক্ষকের রুমে এমন কি নিজ ঘরেও ধর্ষনের আজাব। নতুন বছরে তা নতুন মাত্রার আলামত দিচ্ছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দেওয়া ২০১৯ সালের এক হিসাবে দেখা যায়, বছরটিতে চার হাজার ৬২২ জন নারী ও শিশু ধর্ষণ, হত্যা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার এক হাজার ৭০৩ জন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার ২৩৭ ও ৭৭ জনকে ধর্ষণের পর

হত্যা এবং ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে ১৯ জন। সংখ্যাটি বিপুল। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রকৃত সংখ্যা এর কয়েক গুণ বেশি হবে।অনেক ঘটনাই মামলা না করা, সংবাদপত্রে প্রকাশিত না হওয়ার কারণে অজানা থেকে যায়। বিশেষ করে, নিকটাত্মীয় দ্বারা যৌন নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনাগুলো চাপা পড়ে যায়। ভদ্রপাড়ার অফিস, মিডিয়া, শিক্ষাঙ্গন, চলচ্চিত্রে যৌন নিপীড়ন অতিশ্রুত একটি ব্যাপার।

সরকারি দপ্তরে, হাসপাতালে, পুলিশেও এ ধরনের প্রচুর ঘটনা ঘটে চলছে। এর সঙ্গে আরো একটি উপদ্রব বৃদ্ধি পেয়েছে, সেটি কম বয়সী ছেলেশিশু বলাৎকার। অপরাধটি সাধারণত মাদরাসায় কার্তিক গড়নের শিশুর ওপর ঘটে থাকে। অপরাধটি করে থাকে মাদাসার শিক্ষক বা উচ্চ শ্রেণির সহপাঠীরা। কয়েক দিন আগে এ ধরনের বলাৎকারের ঘটনায় একটি ছেলেশিশু মারা যায়।

গত কয়েক দিনের শীতের দাপটের মধ্যে ধর্ষণের প্রকোপও বেড়েছে। অন্তত সংবাদপত্রের পাতা এবং টিভির সংবাদগুলো তো তা-ই বলে। শীতের ভর মৌসুম এবং তীব্র ঝাঁকুনির মধ্যেও কুকুরের ভাদ্র আশ্বিনের ব্যারাম কেন মানবকুলে? এক সময় শীতে কোনো কোনো মানুষের পাগলামি বাড়তো। আঞ্চলিক নানা নামে সম্বোধন করা হতো এই রোগকে। কুকুরের বিশেষ মৌসুম হিসেবে ভাদ্র-আশ্বিন আলাদাভাবে আলোচিত। এ দুই মাসে মাদি কুকুর দেখলেই হামলে পড়ে মর্দ কুকুর। এ সময়টায় কুকুরের কামড়ের বিষও বেশি।

Advertisement

সচেতন মানুষ তাই নিজ গরজেই সতর্ক থাকে কুকুর থেকে। বাঁচার রাস্তা থাকে মাদি কুকুরেরও। সে অসুস্থতা বা অন্য কোনো ওজর দেখালে মর্দ কুকুরটা শরমে লেজ গুটিয়ে সাইড কেটে চলে যায়। কিন্তু মানুষ মর্দগুলো শরমিন্দা হয় না কোনো মৌসুমেই। এরা শিশু থেকে বৃদ্ধ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী থেকে গার্মেন্টস কর্মী কাউকেই রেহাই দেয় না। শীত-গরম সবই তাদের মৌসুম। এছাড়া, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যার রেকর্ড কুকুরেরও নেই। বেশ কটি ঘটনায় কিছু মানুষের চেয়ে কুকুরের বেশি বোধবুদ্ধি প্রমাণিত।

ধর্ষণের বিচার ব্যবস্থা ও প্রক্রিয়া ধর্ষিতের জন্য খাঁড়ার ঘায়ের মতো বেদনার। আর ধর্ষকের জন্য নিস্তারের। ধর্ষণের বিচারপ্রার্থী হওয়ার যন্ত্রণা হাড়ে হাড়ে টের পান ভুক্তভোগী ও তার স্বজনরা। এ বিচার চাওয়া যেন আরও ধর্ষণের আমন্ত্রণ। বিচারের পথে পদে পদে আরো ধর্ষণেরই হাতছানি। বিচারের সময় নাস্তানাবুদ হতে হয় ধর্ষণের শিকার নারীকে। তার স্বভাব-চরিত্র এবং ইতিহাস নিয়ে এন্তার প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু ধর্ষককে তা করা হয় না। ধর্ষকের আইনজীবী এই সুযোগটা ষোলোআনাই নেন। ধর্ষণের শিকার নারীর চরিত্র হরণ করে তার ছোড়া প্রশ্নগুলো ওই নারীকে আরেকবার ধর্ষণের মতোই।

বলার অপেক্ষা রাখে না, ধর্ষকরা গড়পড়তা সবাই কোনো না কোনোভাবে প্রভাবশালী। কেউ কেউ বেশ সম্মানীয়ও। চন্দ্রবিন্দু (ঁ) দিয়ে সম্মান করতে হয় তাদের। পুলিশ, শিক্ষক, গণমাধ্যম কর্মী, বাস-ট্রাক ড্রাইভার, হেলপার কে নেই এ কাজে? কাকে পাচ্ছে না কুকুরের ভাদ্র-আশ্বিনের রোগে? এদেরকে অমানুষ-পশু বলে গাল দিয়ে বা তাচ্ছিল্য করে প্রসঙ্গ থামিয়ে দেয়া প্রকারান্তরে পার পাইয়ে দেয়া। এরা মানুষ। জাত-গোষ্ঠি, ধর্ম-বর্ণ আছে। কারো কারো পেশাও আছে। পূর্ণ সুস্থতায় বুদ্ধি খাটিয়েই অপকাজগুলো করে চলছে এরা। মজনু মিয়াদের মতো দুয়েকটা ধর্ষক নিজে অক্ষম হলেও প্রভাবশালীর দোয়া বা দয়া হাসিল করতে সক্ষম। ধর্ষিত, তার পরিবার ও মামলাকে আয়ত্তে এনে সমঝোতার ঠকবাজিতে সফল হয় এরা।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

এইচআর/এমএস