বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতা ও মুক্তমত প্রকাশের ইতিহাসে একটি শোকাবহ দিন ১৫ জানুয়ারি। মরণোত্তর একুশে পদকপ্রাপ্ত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অকুতোভয় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মানিক সাহার মৃত্যুবার্ষিকী এদিন। ২০০৪ সালের ১৫ জানুয়ারি দুপুরে খুলনা প্রেস ক্লাবের অদূরে ছোট মির্জাপুর এলাকায় অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের পৈশাচিক বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই জীবনপ্রদীপ নিভে যায় আন্তর্জাতিক সততা পুরস্কারে ভূষিত দেশের একমাত্র কলমসৈনিক ও কণ্ঠযোদ্ধার। ষোড়শ মৃত্যুবার্ষিকীতে মানবপ্রেমী এই গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা ও রক্তিম অভিবাদন।
Advertisement
মানিক সাহা মৃত্যুকালে দৈনিক সংবাদ ও ইংরেজি দৈনিক নিউ এজ পত্রিকার খুলনার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এবং বিবিসি বাংলার খণ্ডকালীন সংবাদদাতা ছিলেন। এর আগে খুলনা প্রেস ক্লাব ও খুলনা সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এছাড়া দেশের প্রথম বেসরকারি টেরিস্ট্রিয়াল সম্প্রচার মাধ্যম একুশে টেলিভিশনের যাত্রালগ্ন থেকে বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত এর খুলনা বিভাগীয় প্রধান ছিলেন মানিক সাহা। (পরবর্তী সময়ে মালিকানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্যাটেলাইটে সম্প্রচারের অনুমতি পায় টিভি চ্যানেলটি; যা এখনও অব্যাহত রয়েছে)। কাপুরুষেরা মানিক সাহাকে শারীরিকভাবে হত্যা করলেও তার আদর্শকে নির্মূল করতে পারেনি। সাহসী ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সাংবাদিকতা এবং মানবমুক্তির সংগ্রামে চিরদিন দিশারী হয়ে আছেন তিনি।
ছাত্রজীবনে বৃহত্তর খুলনা অঞ্চলে ছাত্ররাজনীতি এবং কর্মজীবনের শুরুতে খুলনায় সাংবাদিকতা করার সুবাদে দীর্ঘ দেড় যুগেরও বেশি সময় মানিক সাহার সরাসরি সান্নিধ্য ও স্নেহ-ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ১৯৯৯ সালে খুলনা ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমালেও সেই স্নেহ-ভালোবাসা থেকে কখনও বঞ্চিত হইনি। তাই এ লেখার উদ্দেশ্যই হলো তাকে নিয়ে সামান্য স্মৃতিচারণ করা, তার সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের গণমাধ্যমকর্মীদের কিছু ধারণা দেয়া।
মানিক সাহা কী শুধুই একজন সাংবাদিক ছিলেন? তাকে নির্মমভাবে হত্যার পর দেশের সাংবাদিক সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গনের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিন্দা ও প্রতিবাদের যে ঝড় উঠেছিল, তা দেখে তখন অনেক সাধারণ মানুষ এমন প্রশ্নই তুলেছিলেন। না, তিনি শুধু একজন সাংবাদিক ছিলেন না; তার পরিধি ছিল অনেক বিস্তৃত। মৃত্যুকালে মানিক সাহা একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও দেশের দুটি শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিকের সাংবাদিক ছাড়াও বিশ্বনন্দিত মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, খুলনা চ্যাপ্টারের সভাপতি ছিলেন।
Advertisement
তবে তার পরিচয় এখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ছাত্ররাজনীতি থেকে মানবমুক্তির লড়াইয়ে দীক্ষিত মানিক সাহা নিজেকে বহুমুখী কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত রেখেছিলেন। সে কথা জানাতেই একটু পেছনে ফিরে যেতে হচ্ছে আমাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে ও ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার পর শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এক দুঃসাহসিক কর্মসূচি হাতে নিয়েছিল।
রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করা প্রতিক্রিয়াশীল অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ মানুষের মাঝে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর ছবিসংবলিত পোস্টার লাগাতে শুরু করেছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া ছাত্র সংগঠনটি। এক রাতে খুলনার সরকারি ব্রজলাল মহাবিদ্যালয় (বি এল কলেজ) চত্বরে সেই পোস্টার লাগানোর সময় জেনারেল জিয়ার অনুসারী ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মানিক সাহাকে আটক করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এরপর নির্মম দৈহিক নির্যাতন ছাড়াও সামরিক আদালতের বিচারে ২২ মাস কারাদণ্ড হয় তার। জেলখানায় বসেই স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হন তিনি। আশির দশকে সামরিক-স্বৈরাচার এরশাদ আমলেও গ্রেপ্তার হয়ে আরেক দফা নির্মম নির্যাতন ও দীর্ঘ কারাবাসের শিকার হয়েছিলেন মানিক সাহা।
কিন্তু নির্যাতন-নিপীড়ন সত্ত্বেও মানবমুক্তির লড়াই থেকে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া মানিক সাহা। দারিদ্র্যকে পায়ে মাড়িয়ে স্নাতকোত্তর এবং আইন শাস্ত্রে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন। পেয়ে যান বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সনদ ও খুলনা আইনজীবী সমিতির সদস্যপদ। কিন্তু আইন ব্যবসায় না গিয়ে সাধারণ মানুষের শোষণ-বঞ্চনা ও ন্যায্য অধিকারের কথা সর্বত্র তুলে ধরতে ঝুঁকিপূর্ণ ও অপেক্ষাকৃত কম উপার্জনের সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। দীর্ঘ দুই দশকের পেশাগত জীবনে তার কলমে সেই অধিকারের কথাই বহুবার ফুটে উঠেছিল।
ফসলি জমিতে জোরপূর্বক বাঁধ দিয়ে লোনা পানিয়ে ঢুকিয়ে পরিবেশবিনাশী চিংড়ি চাষের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন তিনি। বিত্তবান ও প্রভাবশালী চিংড়িঘের মালিকদের প্রলোভন ও রক্তচক্ষু তাকে আদর্শচ্যুত করতে পারেনি। বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ও আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের পৈশাচিক নির্যাতনের কাহিনি বিবিসি রেডিওতে মানিক সাহার দরাজকণ্ঠে বহুবার উচ্চারিত হয়েছে।
Advertisement
তাকে হত্যাও করা হয় সেই সরকারের আমলে। জনশ্রুতি আছে, তৎকালীন সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদে তাকে হত্যা করা হয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, খুলনার বিএনপি ও জামায়াতের তৎকালীন দুই সাংসদ, বাগেরহাটের বিএনপিদলীয় এক সাংসদ ও খুলনার জামায়াতপন্থী এক সাংবাদিক ছাড়াও খুলনা বিভাগের তৎকালীন এক মন্ত্রী এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
মানিক সাহা তার সতীর্থ সাংবাদিকদের প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষ যখন নিপীড়িত ও অধিকারবঞ্চিত হয়ে পুলিশের কাছে গিয়ে ন্যায্য প্রতিকার পায় না, ন্যায়বিচারের আশায় বছরের পর বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরে ব্যর্থ হয়, তখন সাংবাদিকরাই হয়ে ওঠেন তাদের একমাত্র ভরসাস্থল। তাই সাংবাদিকদের সেভাবেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।’
হ্যাঁ, মানিক সাহা জীবদ্দশায় সেই দায়িত্বশীলতার পরিচয়ই দিয়ে গেছেন। এ কারণে সাংবাদিকতার গণ্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর খুলনা ও যশোর অঞ্চলে সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পেরেছিলেন তিনি। বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষা ও শিশু সংগঠনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিল তার। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কমরেড রতন সেন পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক, উদীচীর খুলনা জেলা সংসদের সহসভাপতি, খেলাঘর-খুলনা জেলা কমিটির উপদেষ্টা, শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অরতীর্থ বিদ্যাপীঠের সহসভাপতি এবং খুলনার ঐতিহ্যবাহী ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সাউথ হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের একাডেমিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া তার হাতেগড়া অনেক সাংবাদিক এখন ঢাকা ও খুলনায় সুপ্রতিষ্ঠিত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মানবমুক্তির লড়াইয়ে নিবেদিতপ্রাণ এই গুণী মানুষটিকে নৃশংসভাবে হত্যার ন্যায়বিচার পাননি তার স্বজন, সহকর্মী ও সুহৃদরা। ১২ বছর পর ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর খুলনার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবং জেলা ও দায়রা জজ এম এ রব হাওলাদার এ চাঞ্চল্যকর মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ১১ জন আসামির ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুজনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়।
পুলিশের ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্রে হত্যার পরিকল্পনাকারী, অর্থের জোগানদাতা, তাদের পৃষ্ঠপোষক ও ভাড়াটিয়া খুনিদের নাম ছিল না। যে কারণে প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার আড়ালে রয়ে গেছে। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর চাপে পুলিশ স্বাধীনভাবে তদন্ত করতে না পারায় আদালতে ত্রুটিপূর্ণ অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রয়াত মানিক দা’র উদ্দেশে এতোটুকুই বলতে চাই, কাপুরুষেরা তোমাকে হত্যা করলেও তোমার আদর্শকে নির্মূল করতে পারেনি। সাহসী ও নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন সাংবাদিকতা এবং মানবমুক্তির সংগ্রামে তুমি চিরদিন দিশারী রবে।
মৃত্যুঞ্জয়ী মানিক সাহা- তোমার কর্মবহুল স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা, শত সহস্র রক্তিম অভিবাদন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও অধিকারকর্মী।
এইচআর/এমএস