ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়, অটোয়া ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাপানের ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং টেররিজম ইন সাউথ এশিয়া : বিয়ন্ড স্টাটিস্ট ডিসকোর্সেস’ নামক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি।
Advertisement
ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলেইমানির হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের মধ্যকার উত্তেজনা, ফলাফল এবং বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন। ইরানের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সামরিক শক্তির নিবিড় সম্পর্ক আছে বলেও মত দেন। তবে আপাতত মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির আগুন-ই দেখতে পাচ্ছেন এ বিশ্লেষক। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারে আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সোলেইমানি হত্যাকাণ্ডের পর ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক চরমে। হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটছে। এ পরিস্থিতি কীভাবে পর্যক্ষেণ করছেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ : কয়েকটি বিষয় আমলে নিয়ে এমন ঘটনার বিশ্লেষণ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থকাঠামোতে অস্ত্র তৈরি, যুদ্ধাবস্থা রাখা বা যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি করা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ কাঠামো থেকে বের হওয়ার চেষ্টাও হয়েছে কয়েকবার। বিশ্বায়ন-কে সামনে রেখে পণ্য উৎপাদন বাড়ানোর ভাবনা, সে চেষ্টাও করেছে দেশটি। এ চেষ্টায় চীন যতটা লাভবান হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ততটা পারেনি।
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেল আইজেন হাওয়ার বহু আগেই বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি হচ্ছে মিলিটারি কমপ্লেক্স নির্ভর। এ থেকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ এটিই অর্থনীতিকে খেয়ে ফেলছে।’
এ ‘মিলিটারি কমপ্লেক্স’ থেকে যুক্তরাষ্ট্র আসলে বের হতে পারেনি। গত বাজেটে ছয় বিলিয়ন ডলারের ওপরে রাখতে হয়েছে সামরিক খাতে। অর্থনীতির ৩৫ ভাগ উৎপাদন রাখা আছে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের জন্য। এ কারণে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে, যেন অন্যান্য দেশ দেশটি থেকে অস্ত্র কিনতে পারে।
সোলেইমানি হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইরানে বিক্ষোভ
ইরানের পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অর্থনীতির যে কৌশল তা থেকেই সৃষ্টি। অনেকে হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পকে আলাদা করে দেখতে চাইছেন। কিন্তু ওবামাকেও তো যুদ্ধের পথে হাঁটতে হয়েছে। আরেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার বলেছিলেন, ‘বেশির ভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের মধ্যে কাটাতে হয়। ২৬ কী ২৭ বছর যুক্তরাষ্ট্র শান্তি পরিস্থিতির মধ্যে ছিল।’
Advertisement
যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ করতে হয়, এ কারণেই ইরান এখন টার্গেট। এর আগে উত্তর কোরিয়ায় চেষ্টা করেছিল। চীন পাশে থাকায় সম্ভব হয়নি। যদিও উত্তর কোরিয়া নিজেকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
জাগো নিউজ : বলা হচ্ছিল, যুদ্ধপরিস্থিতি থেকে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা পিছু হটছে। বিশেষ করে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের আলোচনা সামনে এসেছিল। হঠাৎ করে ফের যুদ্ধপরিস্থিতিতে যেতে হলো কেন?
ইমতিয়াজ আহমেদ : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীদের সব সময় বলতে শোনা যায়, আমি সৈন্য প্রত্যাহার করব, আমি যুদ্ধের ব্যয় কমিয়ে আনব। এতে বড় একটি সাপোর্টও তৈরি হয়।
জাগো নিউজ : যুদ্ধের কথাও বলতে শোনা যায়…
ইমতিয়াজ আহমেদ : হ্যাঁ। যুদ্ধব্যয় কমানোর কথা এলে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর ঝামেলা তৈরি হয়। সেখানে প্রচুর মানুষ কাজ করে। সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা যখন দেয়া হয় তখন উল্টো কিছু ঘটনার জন্ম দেয়া হয়। তখন সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় যে, দেখ, দেখ, আমি সৈন্য প্রত্যাহারের চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারলাম না। মূলত, দ্বৈত অবস্থান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের সঙ্গে রাজনীতি করা হয়। কিন্তু দেশটির জনগণই এ পরিস্থিতি থামাতে পারে।
জাগো নিউজ : যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ মানুষ আর যুদ্ধের পক্ষে নয়, অন্তত নানা গবেষণায় প্রমাণিত। কাসেম সোলেইমানি হত্যার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়ে সেখানকার মানুষ বিক্ষোভ করেছে, মানববন্ধন করেছে। কিন্তু গণমানুষের মত উপেক্ষা করেই যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। মানুষ আসলে কী ভূমিকা রাখতে পারে?
ইমতিয়াজ আহমেদ : এটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। বেশির ভাগ মানুষের মত উপেক্ষা করার সুযোগ তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান নির্বাচনে জেতার ম্যাজিকটা জেনে গেছে। প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ৫০ শতাংশ ভোট পাওয়ার দরকার নেই। অনেক কম ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট হওয়া যায়। গত নির্বাচনে হিলারি ক্লিন্টনের চেয়ে তিন মিলিয়ন কম ভোট পেয়ে ডোনাল্ট ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হন। তিনি অঙ্ক কষেছেন যে, ৫০ হাজার ভোটে জেতার দরকার নেই। এক ভোট বেশি পলেই হলো। অথবা অমুক রাজ্যে আমার জেতার দরকার নেই। এই এই রাজ্যে জিতলেই হলো। ভারতেও তা-ই হয়েছে গত নির্বাচনে। মাত্র ৩৬ শতাংশ ভোট পেয়ে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পায় বিজেপি।
ইরাকে সোলেইমানির গাড়িবহরে যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোনহামলা
এতে সত্যিকার গণতন্ত্র কার্যকর হচ্ছে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রেসিডেন্ট নন। অথচ, গণতান্ত্রিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা পায় বেশির ভাগ মানুষের রায়ের ভিত্তিতে। তুলনামূলক কম ভোট পেয়েও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট অধিক শক্তিশালী। ১৯৭১ সালে হেনরি কিসিঞ্জারও একই ক্ষমতা দেখিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও প্রশাসন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়। বাংলাদেশে গণহত্যা হচ্ছে জেনেও নিক্সন, হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানকে সমর্থন করে।
জাগো নিউজ : তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ বলা যায় কি-না?
ইমতিয়াজ আহমেদ : অবশ্যই। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকরা এখন তা-ই মনে করছেন। নির্বাচনের এ পদ্ধতি আঠারো শতকের করা। তখন ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। যাতে সংখ্যাগরিষ্ঠরা যেন একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগ করতে না পারেন। কিন্তু এখন হয়ে গেছে উল্টো। কম ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন এবং একতরফা ক্ষমতা প্রয়োগ করছেন।
এ কারণেই গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের পক্ষে মত দিচ্ছেন।
জাগো নিউজ : আলোচনা হচ্ছিল ইরান প্রসঙ্গে। কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এ সময়টা বেছে নিল কেন? আপনার বিশ্লেষণ কী…
ইমতিয়াজ আহমেদ : এখানে দুটি দিক আছে। প্রথমে ইরানের দিকে তাকাতে হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত হয়তো কোনো এক সময় যুদ্ধাপরাধে সামিল হবে। তবে আমার বিশ্লেষণ হচ্ছে, কাসেম সোলেইমানির হত্যা ইরানকে লাভবান করেছে।
জাগো নিউজ : কীভাবে লাভবান…
ইমতিয়াজ আহমেদ : ইরান বহু বছর ধরে বিশ্ব জনমতে প্রবেশ করতে পারেনি। পশ্চিমা মিডিয়া ইরান সম্পর্কে বিশ্বকে যা জানিয়েছে, তা-ই জেনেছে। গরিব, স্বাধীনতা নেই, ইসলামী রক্ষণশীল রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করেছে পশ্চিমা দেশগুলো।
সোলেইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইরান এখন বিশ্বকে পাশে পেয়েছে। জনমত এ হত্যার বিপক্ষে। সঙ্গত কারণে ইরানের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। এতে লাভবান হচ্ছে ইরান। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেও ইরানের পক্ষে মানববন্ধন হচ্ছে, বিক্ষোভ হচ্ছে। এ চিত্র কল্পনাই করা যায় না।
জেনারেল সোলেইমানিকে শেষ বিদায় জানাচ্ছেন ইরানিরা
যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক মিত্র দেশ এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীন, রাশিয়া ইরানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কথা বলছে। ইউরোপের দেশগুলো সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিচ্ছে। ইরাকের পার্লামেন্ট আইন পাস করল, তারা যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার চায়। তার মানে, দীর্ঘমেয়াদে ইরান লাভবান হলো। ইরান সেই লাভ ধরে রাখতে পারে কি-না, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
জাগো নিউজ : লাভের কথা বলছেন। কিন্তু কাসেম সোলেইমানিকে হারানো তো ইরানের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি…
ইমতিয়াজ আহমেদ : এ ক্ষতি সাময়িক। আমার কাছে মনে হয়েছে, ইরান যতটা না শক্তিশালী, তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলোর ভুলের কারণে।
ইরাকে যুদ্ধ বাধিয়ে সাদ্দাম হোসেনকে সরিয়ে দিল যুক্তরাষ্ট্র। ইরাকে শিয়া বেশি। শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্ব পুরনো। এখন শিয়ারা শক্তিশালী হয়ে ইরানের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছে। এটি ইরানের লাভ। এ বোধ যুক্তরাষ্ট্রের নেই।
ইসরায়েলের সীমানায় এখন ইরানের বাহিনী অবস্থান করছে। এটি তো যুক্তরাষ্ট্রের ভুল নীতির কারণেই সম্ভব হয়েছে। সম্প্রসারণ নীতিতে কাসেম সোলেইমানির ব্যাপক ভূমিকা আছে। ইরান পারস্য সভ্যতা ধারণ করে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশটি বহু সোলেইমানি তৈরি করে ফেলেছে। ইরানের বুদ্ধিদীপ্ত অবস্থান তার সামরিক অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছে।
এএসএস/এমএআর/এমএস