আন্তর্জাতিক

সোলেইমানির মৃত্যু ইরানের জন্য আশীর্বাদ

ইরাকে মার্কিন দু’টি সামরিক ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আপাত দৃষ্টিতে দেশটির কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার প্রতীকী প্রতিশোধ হিসেবে ধরে নেয়া যায়। গত ৩ জানুয়ারি ইরানি এই জেনারেলকে হত্যার পর মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব হাজির হয়েছে; সেটি সাময়িক সময়ের জন্য এড়ানো গেলেও এখনও চূড়ান্ত উপসংহারে পৌঁছানো বেশ কঠিনই।

Advertisement

জেনারেল সোলেইমানি হত্যাকাণ্ডের পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছিলেন, ইরানের সশস্ত্র বাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নেবে। ইরানের সর্বোচ্চ এই নেতার কথা ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছেও। তবে একটি বার্তা এসে গেছে, সেটি হলো ইরানি কর্তৃপক্ষ এই সঙ্কট আর বাড়িয়ে তুলতে চায় না। ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি আক্রান্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনিও একই পথে হাঁটতে চান। উত্তেজনা বাড়াতে চান না তিনিও।

কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে পরবর্তীতে ওই অঞ্চলে মার্কিন মিত্রদের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে ইরান আর কোনও প্রতিক্রিয়া দেখাবে না। এ ধরনের আশা বোকামির শামিল। কারণ ইরান একই ধরনের কাজ করেছিল গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবের আবকাইক ও খুরাইস তেল ঘাঁটিতে ভয়াবহ ড্রোন হামলার মাধ্যমে। যদিও এ ধরনের নিম্নমাত্রার গেরিলা যুদ্ধ এখন অনিবার্য নয়; তারপরও অতীতের মতো সামরিক সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পুরোমাত্রায় যুদ্ধ এড়াতে চায় ইরান।

জেনারেল সোলেইমানি হত্যাকাণ্ড তেহরানের জন্য মারাত্মক ধাক্কা হিসেবে হাজির হয় এবং ট্রাম্প কোনও পরিস্থিতিতে যুদ্ধের ঝুঁকি নেবেন না; ইরানের এমন ধারণা, বিশ্বাস কিংবা আস্থাকে নড়বড়ে করে তোলে। মধ্যপ্রাচ্যে গত বছরের একাধিক ছোট-খাটো হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষোভের মাত্রার হিসেব কষতে ভুল করেছিলেন সোলেইমানি; যার মূল্য তাকে দিতে হলো জীবনের বিনিময়ে।

Advertisement

রাজনৈতিক সুবিধা লাভের জন্য ইরান এই হত্যাকাণ্ডকে কাজে লাগাতে পারে। বিশেষ করে ইরাকে তেহরানের প্রভাব বৃদ্ধি এবং তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে কাজ করে। ইরাক থেকে ৫ হাজার ২০০ মার্কিন সৈন্যকে তাড়াতে দেশটির সরকার, সংসদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে দাবি জানাতে পারে। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরাকি সামরিক বাহিনীকে সহায়তার উদ্দেশে ২০১৪ সাল থেকে মার্কিন সৈন্যরা দেশটিতে রয়েছে। কিন্তু জেনারেল সোলেইমানি হত্যার পর সেখানকার দৃশ্যপট পাল্টে যায়। মার্কিন সৈন্যরা নিজেদের সুরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

ইরাক সিরিয়ার বৃহত্তর অঞ্চলে ঘিরে আইএস নিজেদের অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছিল। বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে লড়াইয়ে আইএসের অস্তিত্ব যখন ধুঁকছে, তখন সোলেমানি হত্যাকাণ্ড তাদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ নিয়ে এসেছে। আর সোলেইমানি হত্যায় আইএস যে সুবিধাভোগী হতে যাচ্ছে সেটি একেবারেই পরিষ্কার। কারণ ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদস ফোর্সের সহায়তায় ইরাকি মিলিশিয়ারা আইএসের বিরুদ্ধে সফল লড়াই চালিয়ে আসছিল।

এমনকি মার্কিন সৈন্যরা যদি দেশটিতে থেকেও যায়, তাহলে তাদের জিম্মিদশার মতো একটি পরিস্থিতিতে থাকতে হবে। ইরাকি সামরিক ঘাঁটির মাঝামাঝি জায়গাগুলোতে কিছু অরক্ষণীয় দূর্গ রয়েছে। মার্কিন সৈন্যদের সুরক্ষায় ইরাকি নিরাপত্তার আগ্রহের বিষয়টি নিয়ে এখন সন্দেহ তৈরি হবে। কারণ গত সপ্তাহে বাগদাদের গ্রিন জোনে মার্কিন দূতাবাসে যখন বিক্ষোভকারীরা হামলা চালায়; তখন ইরান সমর্থিত ইরাকের প্যারা মিলিটারির সদস্য ও নেতাদের বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়।

ইতোমধ্যে এই সঙ্কট থেকে তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক অর্জন ইরানের ঝুলিতে জমা পড়েছে। গত বছরের নভেম্বরে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর দেশটির লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বিক্ষোভ দমাতে ইরানের নিরাপত্তাবাহিনী বলপ্রয়োগ ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেছে। এতে কমপক্ষে ৩০৪ জনের প্রাণহানি ঘটে।

Advertisement

কেউ কি প্রত্যশা করেছিলেন দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের দ্বিতীয় প্রভাবশালী এক সেনা জেনারেল মার্কিন হামলায় মারা যাওয়ার পর তার জানাজায় ইরানের রাস্তায় লাখ লাখ মানুষ নেমে আসবেন? লাখ লাখ শোকাহত ইরানি যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিশোধ নেয়ার দাবি জানান। অতীতে বিক্ষোভকারীরা অভিযোগ করেছিলেন যে, বিদেশে যুদ্ধ, প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে দেশের সম্পদ নষ্ট করছে ক্ষমতাসীন সরকার। বিদেশি সেসব অভিযানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনারেল কাসেম সোলেইমানি নিজেই।

সাম্প্রতিক উত্তেজনায় ইরাকে আইএসের সুবিধা কতটুকু হলো তা নিরূপণ করা এই মুহূর্তে কঠিন। সোলেইমানির মৃত্যুতে ইরাকে অনেকেই খুশি হবেন। কারণ বেকারত্বের উচ্চহার কমিয়ে আনা, সরকারি উন্নত সেবা নিশ্চিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিতে গত অক্টোবর থেকে ইরাকেও ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। ইরাকের বিক্ষোভ দমনে দেশটির সরকারকে সহিংস দমনের উপায় বাতলে দিয়েছিলেন ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানি।

সরকারি বাহিনীর সহিংস দমনে ইরাকে অন্তত ৫০০ বিক্ষোভকারী নিহত হন। এছাড়া আহত হয় আরও ২০ হাজারের বেশি মানুষ। ইরানি জেনারেল হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ইরাকের বিক্ষোভকারীদের পায়ের তলা থেকে যে মাটি সরিয়ে দেয়া হয়েছে; তা বললেও বেশি হবে না। কারণ ইরাকে মার্কিন হস্তক্ষেপের অর্থই হচ্ছে ইরানি হস্তক্ষেপ দূর করা। আর এখন ইরাকের কোনো নেতাই আমেরিকানপন্থী হিসেবে পরিচিত হতে চাইবেন না। ইরানপন্থী ইরাকের প্যারা মিলিটারির সদস্যরা এখন নিজেদের ইরানি প্রক্সি হিসেবে নয়, বরং দেশপ্রেমী হিসেবে জাহির করতে পারবেন।

সোলেইমানি দুই দশকের বেশি সময় ধরে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর বিদেশি সশস্ত্র শাখার প্রধান হিসেবে যা অর্জন করেছিলেন, মৃত্যুর মাধ্যমে দেশের জন্য তারচেয়েও বেশি করে গেলেন তিনি। মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, তার মৃত্যু ইরানের জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ এবং দেশটির ক্ষমতাসীন সরকার ও আঞ্চলিক মিত্রদের আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে আরও শক্তিশালী করেছে।

ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্টে প্যাট্রিক ককবার্নের লেখা কলাম অবলম্বনে।

এসআইএস/পিআর