ইরাকের এরবিল এবং বাগদাদের কাছে আল আসাদে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় ক্ষয়-ক্ষতি বা প্রাণহানির চিত্রটি এখনো অস্পষ্ট। ইরানের বিভিন্ন সূত্র থেকে দাবি করা হচ্ছে, দুটি ঘাঁটিতে ৬০ থেকে ৮০ জন নিহত হয়েছে।
Advertisement
কিন্তু আমেরিকানদের পক্ষ থেকে এখনও কিছু শোনা যায়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আনুষ্ঠানিক বিবৃতির জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে মার্কিন ঘাঁটিতে ইরানের এই হামলা কি দুই বৈরি দেশের মধ্যে যুদ্ধের সূচনা করলো, নাকি এই হামলায় কাসেম সোলেইমানিকে হত্যার পর সৃষ্ট উত্তেজনা প্রশমনের রাস্তা তৈরি হলো?
বিশ্লেষকরা তেহরান এবং ওয়াশিংটনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াগুলো ঘেঁটে বোঝার চেষ্টা করছেন পরিস্থিতি কোনো দিকে গড়াতে পারে। ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, তারা আমেরিকার মুখে চপেটাঘাত করেছেন। তার এই কথার লক্ষ্য যে ইরানের ক্ষুব্ধ জনগণ, সন্দেহ নেই।
কিন্তু ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে যা বলেছেন সেদিকেই গুরুত্ব দিয়ে নজর দিচ্ছে বাইরের বিশ্ব। এক টুইট বার্তায় জারিফ বলেছেন, ইরান জাতিসংঘ সনদের ৫১ ধারা অনুসরণ করে তার আত্মরক্ষায় যথাযথ জবাব দিয়েছে, এবং জবাব দেওয়া শেষ করেছে। আমরা পরিস্থিতিকে আর উত্তপ্ত করতে চাই না বা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু আক্রান্ত হলে আত্মরক্ষা করবো।
Advertisement
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত কয়েকদিন ইরানকে লক্ষ্য করে একের পর এক হুমকি ধামকি দিলেও, ইরানের এই হামলার পর এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে তেমন কোনো ক্রদ্ধ কোনো প্রতিক্রিয়া শোনা যায়নি।
এক টুইট বার্তায় তিনি বলেছেন, সবকিছু ঠিক আছে। ইরাকে দুটি সামরিক ঘাঁটিতে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি প্রাণহানির হিসাব চলছে...এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিক আছে।
বাগদাদ থেকে বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সম্পাদক জেরেমি বোয়েন বলছেন, জারিফের টুইট দেখে মনে হচ্ছে তিনি উত্তেজনার প্রশমন চাইছেন। তিনি (জাভেদ জারিফ) বলেছেন, ইরানের হামলা শেষ হয়েছে এবং ইরান এটা করেছে আন্তর্জাতিক আইনের আওতার মধ্যে থেকে।
বোয়েন মনে করছেন ইরান সম্ভবত এখন বলটি আমেরিকার কোর্টে ঠেলে দিতে চাইছে। কারণ ইরান জানে দুই দেশের মধ্যে সামরিক শক্তিতে তারা কতটা পেছনে। বিবিসির প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংবাদদাতা জনাথন মার্কাসও মনে করছেন, জেনারেল সোলেইমানির মত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একজন জেনারেলের হত্যাকাণ্ডের বিবেচনায় ইরানের এই বদলা খুবই সাদামাটা।
Advertisement
তিনি বলছেন, যে সময়ে এই হামলা চালানো হয়েছে, বোঝাই যায় তার লক্ষ্য ছিল প্রাণহানি এড়ানো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে ইরানের ঠেলে দেয়া বলটি কীভাবে খেলবেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
এখন পর্যন্ত যে কথা-বার্তা তেহরান এবং ওয়াশিংটন থেকে শোনা যাচ্ছে তা দেখে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্লেষক হুমায়ুন কবির মনে করছেন, দুই দেশই বড় কোনো সংঘাতে জড়াতে চাইছে না। এমনকি যদি কিছু প্রাণহানিও হয়ে থাকে, তারপরও আমার মনে হয় আমেরিকা হজম করে নেবে।
তিনি বলছেন, এখন মধ্যপ্রাচ্যে আরেকটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে ট্রাম্প বা মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার যেসব মিত্র দেশ রয়েছে তারা কেউই চায় না। এর পেছনে অর্থনীতির সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইরাক যুদ্ধে আমেরিকার অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, সে সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল। ইরানের সাথে যুদ্ধে সেই ক্ষতি কয়েকগুণ হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক হুমায়ুন কবির বলেন, একইসাথে ইরানের অর্থনীতির যে বেহাল দশা তাতে আমেরিকার মত একটি অত্যন্ত শক্তিধর দেশের সাথে যুদ্ধ করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। এছাড়াও নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী কোনো সংঘাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জড়াতে চাইবেন বলে মনে হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ইরানের হাতে জিম্মি মার্কিন কূটনীতিকদের উদ্ধারে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই কিন্তু ১৯৭৯ সালে জিমি কার্টার নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। সুতরাং আমার মনে হয় ট্রাম্প হয়তবা তেমন কোনো ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। কবির মনে করছেন, এখন বড়সড় কূটনৈতিক তৎপরতার সূচনা হতে পারে যার আওতায় ইরাকে মার্কিন ঘাঁটি থেকে শুরু করে পারমাণবিক চুক্তি এবং নিষেধাজ্ঞার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চলে আসবে।
লন্ডনে স্কুল অব ইকোনমিক্সের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ফাওয়াদ গেরজেসও মনে করছেন বড় কোনো সংঘাত দু'দেশই এখন এড়াতে চাইছে। তবে একইসাথে তিনি মনে করে, মধ্যপ্রাচ্যে তাদের লক্ষ্য অর্জন থেকে ইরান সরবে না।
ইরাকসহ তার আঙ্গিনার কাছের দেশগুলো থেকে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতির অবসান চায় ইরান। সেইসাথে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে বেরিয়ে আসনতে চায় তারা। অধ্যাপক গার্জেস মনে করেন, লক্ষ্য অর্জনে নিজেরা ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মদত-পুষ্ট এবং অনুগত মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলোকে ব্যবহার করেই চলবে।
সুতরাং নিশ্চিত থাকতে পারেন যে ইরান এবং তাদের সঙ্গীদের সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মিত্রদের দীর্ঘস্থায়ী একটি সংঘাতের সূচনা হলো মাত্র।
এসআইএস/এমএস