মতামত

রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র

কাঁচের ঘরে বসে ঢিল মারলে বিপদ হতে পারে এটা সকলেরই জানা। ‘আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্র চলছে’ বলে ঠিক সেই ধরনেই একটা ঢিল মেরেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। ৫ জানুয়ারি তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ একটা পরিবারের হয়ে যাচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরিবারের সদস্যকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, সংগঠনগুলোর নেতৃত্বেও পরিবারের লোকজন। এ অবস্থার পরিবর্তন আনতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’ এই কথাগুলো ‘ সুইকে ঝাঝরি বলে, তোর পিছনে ফুটো’ প্রবাদটাকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

Advertisement

আসলে বিএনপির ঘাড়ে পরিবারতন্ত্র ভালভাবেই জেঁকে বসে আছে। এটা কার না জানা যে, বিএনপিতে যোগ দেওয়া কিংবা পদ পাওয়ার আগেই জিয়া-খালেদা জিয়া পুত্র তারেক জিয়া দলের ভেতরে কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থান নেন। এই ‘সুযোগ্য পুত্রটি ‘ ছেড়া গেঞ্জি আর ভাঙ্গা সুটকেস’-এর কাহিনীকে গল্পে পরিণত করে ১৯৯১-৯৬ মায়ের শাসনামলের সুযোগ নিয়ে বিশাল ধনসম্পদের মালিক বনে যান। এরপর ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজনৈতিক প্রচারে সাথে রেখে ছেলেকে এমনভাবে প্রজেক্টেড করতে থাকেন যে, ছেলেই হচ্ছে দলে আগামী দিনের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী। তখন তার বয়স মাত্র ৩৪ বছর। প্রবাদ বলে সকালই বলে দেয় দিনটা কেমন যাবে। শিক্ষা, আচার ব্যবহার ও স্বভাবের দিক থেকে তার বায়োডাটা একবারেই ভালো ছিল না। এতদসত্ত্বেও তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

দলের কেউ বা নেতা না হয়েও প্রথম থেকেই রাজনীতিতে নাবালক তারেক তার পিতার সহযোগী বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও বর্ষিয়ান নেতাদের সাথে অসম্মানজনক ব্যবহার করতে থাকে । এর প্রথম বলি হন তখনকার রাষ্ট্রপতি ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০২ সালে হঠাৎ করে সম্মেলন নয়, স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তের ভেতর দিয়ে নাটক করে তিনি বিএনপি দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব হিসাবে নিয়োগ পান। এই পদে অধিষ্ঠিত হয়েই তিনি প্রধানমন্ত্রীর সরকারি অফিসকে দলীয় অফিসের অধীনস্ত করে ফেলেন এবং দলীয় অফিস ‘ হাওয়া ভবন’-কে দুর্নীতি-লুটপাট-সন্ত্রাসসহ সব অনৈতিক কাজের কেন্দ্রে পরিণত করেন। অনৈতিকতা ও অসভ্যতার আখড়া ‘ খোয়াবভবন’ তারই সৃষ্টি। বিদ্যুৎ উৎপাদন না হয়ে খুঁটি হওয়া, বিমানের জ্বালানি কেরাসিন হওয়া প্রভৃতি দুর্নীতির কিচ্ছাকাহিনী তারই কীর্তির ফসল। ‘বাংলাভাই’ ও মুফতি গংদের উত্থান আর বোমা- গ্রেনেডবাজি করে আওয়ামী লীগ নেতা-বুদ্ধিজীবীদের ফিনিস করে দেওয়া হচ্ছিল তারই উস্কানিতে।

জামায়াতকে ‘ আত্মার আত্মীয়’ করে এই নেতাই রাজাকার-আলবদরদের বাড়িতে-গাড়িতে শহীদদের রক্তরঞ্জিত জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলো। এমনকি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী ডন ইব্রাহীমকে এই নেতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নাক গলানোর সুযোগ করে দেয়। ‘টু ইন ওয়ান’ তথা রাষ্ট্রপতি ও তত্ত্ববধায়ক সরকার প্রধান ড. ইয়াজউদ্দিনকে পুতুল হিসাবে বসিয়ে ‘ ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর ব্যবস্থা সম্পন্ন করে এই নেতাই তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থায় শেষ পেরেকটি পুঁতে দিয়েছিলো। এসব কাজে এই নেতাটি অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন বলেই উইকিলিক্স-এর ফাঁস করা ঢাকাস্থ আমেরিকান এম্বেসীর রিপোর্ট থেকে দেশবাসী জানতে পারে, বিএনপির দু‘ নম্বর এই নেতা হলেন, ‘ গুরুতর রাজনৈতিক দুর্নীতির জন্য দোষী’ । বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের এই নেতাটিকে দেশে-বিদেশের সবাই ঘৃণা করে, কেউ পছন্দ করে না । বহু মামলার আসামী হয়ে ‘পিটুনি খেয়ে’ অলিখিত মুচলেকা দিয়ে মায়ের দেনদরবারে ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর এই নেতা দেশত্যাগ করেন।

Advertisement

গণবিচ্ছিন্নতা- হতাশা -অকার্যকারিতা- অন্তর্দ্বন্ধে জর্জরিত হয়ে বিএনপির আজ যে দুরবস্থার মধ্যে রয়েছে, তার জন্য যে ‘ভাইয়া’ দায়ী এটা সবার জানা! তবুও বিএনপি এই নেতাকে ঘাড় থেকে নামাতে পারছে না। বরং তাকে ২০০৯ সালের সম্মেলনে বিদেশে থাকা সত্ত্বেও প্রমোশন দিয়ে সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন বানিয়েছে। এখন তিনি পলাতক সত্ত্বেও দলের এক নম্বর নেতা। ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না’ প্রবাদটা ইতোমধ্যে প্রমাণ করেছেন তারেক জিয়া। মা জেলে আর দল বিধ্বস্ত থাকা সত্ত্বেও বিগত নির্বাচনে লন্ডনে বসে তারেক জিয়া মনোনয়ন বাণিজ্য ও পরে স্কাইপিতে ইন্টারভিউ নিয়ে যে কাণ্ড করেছে, তা দস্যুতা ও মায়ের প্রতি ভালবাসা পদদলিত করারই নামান্তর। তবু তিনিই দলের প্রধান। কারণ তিনি যে ‘ সুযোগ্য পুত্র!

সবশেষে প্রশ্ন হলো অভিজ্ঞ রাজনীতিক ফখরুল ইসলাম আলমগীর কি বিএনপিতে পরিবারতন্ত্র জেঁকে বসার এসব কাহিনী জানেন বা বুঝেন না। ঢাকা মহানগরের দুই মেয়র প্রার্থী তো পরিবারতন্ত্রেই ফসল। তবু তিনি কেন কাঁচের ঘরে বসে ঠিল ছুড়লেন? পরিবারতন্ত্র সম্পর্কে এমন কথা হঠাৎই বললেন ? এটা কার না জানা যে, খালেদা জিয়া জেলে, তারেক জিয়া পলাতক এবং দল বিধ্বস্ত থাকা সত্ত্বেও ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা মিলিয়ে বিএনপি ধারার রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের একটা ভালো অবস্থান বাংলাদেশে রয়েছে। জামায়াত বা ইসলামী ঐক্যজোটের রাজনীতির সাথে এই ধারা তেমন মিলে না। জনগণ ধর্ম নিয়ে উগ্রতা পছন্দ করে না। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া এবং ১৯৯১-৯৬ খালেদা জিয়া এটা বুঝেই ক্ষমতা থেকে জামায়াতকে তফাতে রেখে ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু অর্বাচীন নেতা তারেক পিতা ও মাতার সেই কৌশলকে পদদলিত করে ওই শক্তিকে বুকে টেনে নিয়েছিল। ফলাফল দেশবাসী তো বটেই এমনকি মির্জা ফখরুলদেরও অজানা নয়।

তাই বিগত নির্বাচনের আগে ফখরুলের নেতৃত্বে বিএনপি ড. কামালদের সাথে ঐক্যজোট গঠন করে ওই ধারাকে আবারও দেশের ক্ষমতার রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক করতে চেয়েছিলেন। জামায়াত বাদে জোট এবং জামায়াতকে সাথে রাখা- তখন এই মতপার্থক্যে বিএনপি দলে দুই ধারা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল। বিএনপি জামায়াত ছাড়বে ফখরুল অংশের এই আশ্বাসে ড. কামাল ও তাঁর সহযোগী দলগুলো বিএনপির সাথে ঐক্য করেছিল। ড. কামাল তাই নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, জামায়াত যে বিএনপির সাথে থাকবে তা তিনি জানতেন না। কিন্তু মির্জা ফখরুলদের সেই কৌশল কার্যকরী হলো না কেন? সবারই এটা জানা লণ্ডনপ্রবাসী প্রধান নেতা তারেক এই কৌশল কার্যকর করতে ছাড়পত্র দেয় নাই। এমনকি দল ও জোটের নির্বাচিত সবাই সংসদে যোগ দিলেও সংসদের ভেতরে-বাইরে সংগ্রাম করার চিরায়ত কৌশল বর্জন করে বিজয়ী ফখরুল সাহেবকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। কৌশল কার্যকর করতে না পারা কিংবা পদত্যাগ করতে হয়েছে বিধায় ক্ষুব্ধ হয়ে কি তিনি দলে জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকা পরিবারতন্ত্রকে আঘাত করলেন? কাঁচের ঘরে বসে ঢিল ছুড়লেন? এমনটাই তো মনে হয়।

প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া উল্লেখিত দুই দলের নেতৃত্বে এসেছিলেন, তারেক জিয়ার চাইতে ভিন্ন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। ক্রেইন দিয়ে টেনে তুলে তাদের কেউ নেতা বানান নি। শেখ হাসিনা দলের প্রয়োজনে রাজনীতিতে এসেছিলেন। বংশ ও রক্ত সম্পর্কে আমাদেরসহ বিশেষভাবে উপমহাদেশের গণমনস্তত্ত্বে যে বিশ্বাস বা মোহ প্রোথিত রয়েছে, তাতেই তিনি নেতা হয়েছিলেন, এমনটা কিন্তু নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জেলহত্যা এবং নেতারা সবাই খুনি মোশতাকের নেতৃত্বে মন্ত্রিত্ব নেওয়ায় দলের দুরাবস্থা ও ভাঙ্গন দূর করতে নেতারাই শেখ হাসিনাকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সভাপতির আসনে বসিয়েছিল। দলের প্রধান নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তিনি নিজ গুণ দিয়ে, ধারাবাহিকভাবে যোগ্যতা অর্জন করে। সর্বোপরি ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে সক্রিয় ও উদ্যমী পদচারণা ছিল তাঁর।

Advertisement

পাকিস্তানী আমলে ষাটের দশকের গণজাগরণে তিনি জনপ্রিয় ছাত্রনেত্রী হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটা কার না জানা যে, তখন বিশেষভাবে ছাত্রীদের মধ্যে রুশপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের ছিল একাধিপত্য। তবু তিনি ‘ছোট ইডেন’ কলেজের সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। অভিজ্ঞতা থেকে বলি, আমরা নিশ্চিত ছিলাম ওই নির্বাচনে আমাদের সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন জিতবে। কিন্তু তখনকার ছাত্রী হিসাবে শেখ হাসিনা অপূর্ব সাংগঠনিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে এবং ৬ দফাকে ছাত্রদের মধ্যে ‘মুক্তিসনদ’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় রোকেয়া হলের ছাত্রলীগের সভাপতি হিসাবে গণঅভ্যুত্থাণে ভূমিকা রেখেছেন। আ্ইয়ুবের গোলটেবিলে যোগদানের জন্য প্যারোলে শেখ মুজিবের যোগদান করার পক্ষে যে শক্তিশালী লবি আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগে দাঁড়িয়েছিল, জনগণের মুড বুঝে এই লবির বিরুদ্ধে তথাকথিত আগরতলা মামলায় পিতার ফাঁসি হতে পারে জেনেও বেগম মুজিবের সাথে কন্যা ছাত্রনেত্রী শেখ হাসিনাও দাঁড়িয়েছিলেন। সাংগঠনিক প্রতিভা, রাজনীতির অভিজ্ঞতা, সাহস, দূরদর্শীতা প্রভৃতি গুণাবলীর তাঁর মধ্যে তখনই বিদ্যমান ছিল।

১৯৭৫-৯৬ সময়কালে ‘ আওয়ামী লীগের অবস্থা হবে মুসলিম লীগের মতো’ কিংবা ২০০১-০৮ সময়কালে ‘ ২১ বছর কেন ৫১ বছরেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসতে পারবে না’ -এইসব ভবিষ্যতদ্বাণীকে তিনি মিথ্যা প্রমাণ করতে পেরেছেন। পরিবার বলতে কাদের তিনি বুঝেন, তা বারবার চিহ্নিত করেছেন। ১১ বছর ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁর চিহ্নিত পরিবারের কাউকে উত্তরাধিকার হিসাবে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ক্ষমতা ব্যবহার করে বসাতে যান নাই। ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিট্যাল বাংলাদেশ স্বপ্ন বাস্তবায়নে কিংবা কন্যা সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল অটিজমে নিজেদের যোগ্যতা বলেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। উল্লেখ্য রাজনৈতিক অঙ্গনে পুত্র জয়সহ পরিবারের নতুন প্রজন্মের কারো কারো পদচারণা রয়েছে। নিজ যোগ্যতা দক্ষতা দিয়ে রাজনীতি করার এবং নেতা হওয়ার অধিকার সকলেরই রয়েছে। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করে কেউ যদি আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হন, তবে আক্ষরিকভাবে তা পরিবারতন্ত্র হলেও বাস্তব বিচারে তাকে পরিবারতন্ত্র বলা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। তবে বংশ ও রক্ত সম্পর্কে আমাদের দেশে গণমনস্তত্ত্বে যে বিশ্বাস বা মোহ রয়েছে, গুণাবলী ও যোগ্যতা থাকলেও এর সুযোগ তো তারা নিতেই পারেন।

ঠিক একই রকম না হলেও এরশাদ আমলে খালেদা জিয়া বিএনপিকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রয়োজনেই রাজনীতি ও দলে যোগ দেন। গৃহবধূ ছিলেন তিনি। কোনে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। কিন্তু যুগপৎ আন্দোলনে আওয়ামী লীগের সাথে সমঝোতা করে দলকে রক্ষা ও অগ্রসর করেন তিনি। বলাই বাহুল্য বংশ ও রক্ত সম্পর্কে আমাদের দেশের গণমনস্তত্ত্বে যে বিশ্বাস বা মোহ রয়েছে, তা ব্যবহার করে খালেদা জিয়া বিধ্বস্ত দল বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছিলেন, দুইবার প্রধানমন্ত্রীও হয়েছেন। এখানেই রয়েছে মাতা খালেদা থেকে ছেলে তারেক জিয়ার পার্থক্য। মায়ের কারণে তারেক জিয়া উড়ে এসে জুরে বসেছেন। এই পদ্ধতিতে নেতা হতে গুণাবলী বা যোগ্য লাগে না। তারেক তেমনই এক নেতা, যিনি দলকে পথে বসিয়েছেন। এখন বিধ্বস্ত বা বিলীন হওয়ার পথে দল। তাই বলা যায় বিএনপি পড়েছে জিয়া পরিবারের ঘেরাটোপের মধ্যে। দেশের তৃতীয় দল জাতীয় পার্টিও রয়েছে পরিবারতন্ত্রের অক্টোপাসের জালে আবদ্ধ।

উল্লেখিত পর্যালোচনা যখন করা হচ্ছে, তখন কিন্তু দেশের প্রধান দুই দলের তৃণমূলে যে পরিবারতন্ত্র ক্রমে প্রসারিত ও শক্তিশালী হচ্ছে, তা কিন্তু ভুলে যাওয়া হচ্ছে না। দুই দলেই দেখা যাচ্ছে এমপি ও জনপ্রতিনিধি কারো মৃত্যু হলে কিংবা অবসর নিলে স্ত্রী, পুত্র, ভাই বা আত্মীয় প্রার্থী হয়ে যাচ্ছে। মূলত প্রার্থী নিয়ে কোন্দল ঠেকাতে ডেকে নিয়ে গিয়ে পর্যন্ত তাদের প্রার্থী করা হচ্ছে। বিরল ব্যতিক্রম বাদে এলাকায় এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের নিকট আত্মীয়দের দখল দাপট নিয়ে বাড়াবাড়ির কথাও সর্বজনবিদিত। নিঃসন্দেহে এটা দেশের রাজনীতির জন্য অশুভ লক্ষণ। এই কালো মেঘ ক্রমেই ক্ষমতার রাজনীতিতে ব্যাপ্ত হচ্ছে । যারা পরিবারের কারণেই কেবল এক ধাক্কায় পদপদবী পাচ্ছেন, তাদের দলে গণতন্ত্র চাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা থাকাটাই স্বাভাবিক। দল যদি গড়ে না ওঠে গঠনতন্ত্র মোতাবেক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে তবে দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে না।

গণতন্ত্রের কথা যখন লিখছি, তখন দীর্ঘকাল গণতন্ত্রের ভেতর দিয়ে চলা ভারতের ক্ষমতার রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের পরিধি কতটুকু বিস্তৃত ও গভীর তা বিবেচনায় নিতেই হলো। বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রার্থী বিশ্লেষণে দেখা যায়, জাতীয় কংগ্রেসে ৩১ শতাংশ এবং বিজেপি ২২ শতাংশ প্রার্থী পরিবারতন্ত্রের কারণে দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। কোনো কোনো রাজ্যের জাতীয় পার্টিগুলোতে ৬০ শতাংশ প্রার্থী পরিবারতন্ত্রের কারণে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। আমাদের না হয় প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সামরিক কর্তাদের শাসন ছিল , ক্ষমতায় থেকে রাজনীতি করার ধারা ছিল ; কিন্তু ভারতে তা ছিল না। ভারতের অভিজ্ঞতা দেখিয়ে দেয়, এই উপমহাদেশে ক্ষমতার রাজনীতিতে বংশ ও রক্তের তথা পরিবারতন্ত্র কতটা বিস্তৃত ও গভীর । এই দিকটা মনে রেখেই আমাদের দেশে গণতন্ত্র চর্চা ও সংস্কৃতির উন্নতি ও অগ্রগতির স্বার্থে পরিবারতন্ত্রের ক্ষতিকর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে জনগণকে সচেতন করার পথে যাওয়া ভিন্ন বিকল্প নেই।

লেখক : রাজনীতিক।

এইচআর/জেআইএম