রাতে ঘুমাতে গেলাম সকালে উঠেই প্রথম যে খবরটি পেলাম সেটি হচ্ছে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোট বোন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণ করে মেয়েটিকে আঘাত করে ফেলে রেখে গেছে শয়তানের লোকাল এজেন্ট পুরুষেরা। সকল পুরুষ খারাপনা আবার সকল পুরুষ ভালোও না। কতিপয় পুরুষ নামক কীটের হাতে আজ পিষ্ঠ হচ্ছে নারীজাতি নানাভাবে, নানা জায়গায়। চারপাশে কেবল অস্থিরতার দোলনায় দুলছি আমরা সবাই। দেশ আগালেও সমাজ পিছাচ্ছে।
Advertisement
আজ দুধের শিশু থেকে মৃত্যুপথযাত্রী বয়স্ক নারী কেউই বাদ যাচ্ছে না পুরুষের থাবার আক্রমণ থেকে। এ কী পুরুষদের যৌন ক্ষুধা না ক্ষমতার প্রদর্শন? না মানসিক বিকৃতির প্রকাশ? উত্তর জানা নেই আমার। এ নিয়ে গবেষণার সময় এসেছে। এই ধর্ষণের মহামারী কেবল আমার দেশেই নয় চলছে গন্ডির বাইরেও। পাশের দেশ ভারতের ঘটনাগুলো সবকটিই আমাদের নজরে আসে। প্রতিবাদ প্রতিরোধে জ্বলে উঠে সাধারণ জনতা। আমাদের দেশেতো তাও হয় না। আমাদের মধ্যে শত বিভক্তি যেন এক হতে দেয় না আমাদের। নারী কী তবে রাজনীতির অংশ এ দেশে? জানিনা। এর উত্তরও জানা নেই আমার কাছে।
কেবল এটুকু জানি দিনে দিনে আমার জন্য, আমার মত কোটি নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়ছে এ সমাজের রাস্তা ঘাট, আঙ্গিনা সব। তবে কি আমরা চলা বন্ধ করে দিব? তাহলে যেসব শিশু ধর্ষিত হচ্ছে তাদের কী দোষ? তারা কি তবে জন্ম নেবেনা আর? উত্তর দিবে কেউ? আছে কারও কাছে এর সমাধান? সমাধান চাইবো কোথায়? আইনের গতি আজ কোথায় যেন হারিয়ে দিশেহারা। দিনের পর দিন আমরা এক কঠিন সময়ের দিকে এগুচ্ছি। কে দিবে আমাদের কন্যাদের ভরসা?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীটিতো কারও কোন ক্ষতি করেনি। অন্য আর সব সাধারণ মানুষের মত সেও চলছিলো জীবনের তাগিদে। বন্ধুর বাসায় যাবে বলে বাসে উঠেছিলো কিন্তু বাস থেকে নেমে সেই বন্ধুর বাসাতেই গেলো তবে ক্ষত বিক্ষত হয়ে সাহায্য চাইতে। আমি সাবাসী দেই আমার বোন, আমার কন্যার। সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেনি। ফিরেছে। সে আঘাতে মরে যায়নি। উঠে দাঁড়িয়েছে। রুখে দাঁড়িয়েছে। মামলা করেছে।
Advertisement
এই অবস্থায় একজন নারীর মানসিক অবস্থাটা আমরা কল্পনা করতেও ব্যর্থ। তবে সে ধ্বংসের মাঝে ক্ষয়ে যায়নি। জ্ঞান ফিরার পরই রিক্সা নিয়ে বন্ধুর বাসায় গিয়েছে এবং মামলা করতেও ভুল করেনি। এটাই নারীর শক্তি। আমি তাই তোমাকে কৃতজ্ঞতা জানাই বোন। তুমি ছেড়ে দিওনা। ছেড়ে দিওনা সেইসব নরপশুদের কারণ এই পশু খোলা সমাজে বেঁচে থাকার অধিকার রাখেনা। যে পশু চিকিৎসার উর্ধ্বে ওঠে যায় তাকে বাঁচিয়ে রাখাটা বোকামি। তাই ধর্ষকদেরকেও আমি একই প্রজাতির মনে করি। এইসব ধর্ষকের সুস্থ ও স্বাভাবিক সমাজে বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই, থাকতে পারে না। নারী বা কন্যা শিশুর যদি স্বাভাবিকভাবে বাঁচার কোন নিরাপত্তা না থাকে তাহলে ধর্ষকের মত অপরাধীর কেন থাকবে? আমার অধিকার হরণকারীর কোন অধিকারকে আমি মানি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে তারা সবরকমভাবেই ধর্ষিত মেয়েটির পাশে আছে। আমরা চাই এই ঘটনায় কর্তৃপক্ষ বিচারের দাবিতে অনঢ় থাকবেন। দোষী ব্যক্তির সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা ছেড়ে দিবেন না। এই সমাজকে নিরাপদ করতে হলে রাষ্ট্রের পাশাপাশি আমাদের নাগরিকদের দায়িত্বকেও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। আমি জানিনা মেয়েটিকে যখন ধর্ষক অনুসরণ করছিলো তখন আশেপাশে কেউ ছিলো কিনা? মেয়েটি কারও কাছে সাহায্য চেয়েছিলো কি না বা কেউ এগিয়ে আসতে চেয়েছিলো কি না।
কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট থানার অধীনে একটি এলাকা যেখানে রয়েছে আমাদের দেশের সশস্র বাহিনীগুলোর কার্যালয় ও আবাসিকভবনও। তাহলে এই এরিয়াতেই যদি চলাচল নিরাপত্তা না পাওয়া যায় বা বিপদে সাহায্য পাওয়া না যায় তাহলে সাধারণ এলাকাগুলোর অবস্থা সহজেই অনুমেয়। দেশের প্রতিটা জায়গা আজ নারীর জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। এমতাবস্থায় আমরা নারীরাই কেবল চিৎকার করে যাচ্ছি। “নিরাপদ সমাজ চাই” এই শ্লোগানে আন্দোলন শুরু করাটা অত্যন্ত জরুরি বলেই মনে করছি। হাটে মাঠে ঘাটে কোথাও নারীরা নিরাপদ নয়। ঘর থেকে বাইর সবজায়গাতেই ওঁত পেতে থাকা শয়তানেরা নারীর গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
রাষ্ট্রের কাছে, সরকারের কাছে দাবি রইলো আপনারাই তবে সিদ্ধান্ত দিন এই রাষ্ট্র কাদের জন্য করতে চান আপনারা? এই রাষ্ট্রে কি তবে নারীদের জন্য কোন স্থান নেই? হবে না? তাহলে পিতামাতাদের নির্দেশ দিয়ে দিন তারা যেন ফিরে যায় সেই যুগে যে যুগে কন্যা শিশু হলে তাকে জ্যান্ত মেরে ফেলা হতো। ব্যস, ল্যাঠা চুকে যাবে। যদি তা না করেন তবে প্রতিটা ঘটনার বিচার নিশ্চিত করাটাও আপনাদের দায়। একটি নারীবান্ধব সমাজ গড়ে তুলতে ভূমিকা আছে সরকারের প্রতিটা স্তরের। আইনের শাসনের ভূমিকা এখানে সবচেয়ে বড়।
Advertisement
ধর্ষণকে “জিরো টলারেন্স” ঘোষণা দিয়ে অবলম্বে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা দিন। দুই চারটা অপরাধীর যদি শাস্তি হয় তবেই একটা মেসেজ যাবে। তবেই সম্ভব সমাজকে ধর্ষকের হাত থেকে রক্ষা করতে। সভ্য দেশে কখনও নারীরা অনিরাপদ থাকে না। নারীকে অনিরাপদ রেখে উন্নত দেশ হওয়া সম্ভব নয়। সমাজের প্রতিটা স্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। স্কুলে, কলেজে, ক্লাব, মসজিদ,মন্দিরের মাধ্যমে সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষার প্রচার করতে হবে। ধর্ষণবিরোধী মানসিকতাকে গঠন করতে ভূমিকা রাখতে হবে।
সাংস্কৃতিক অবক্ষয় আজ ভয়াবহ। কোথাও সংস্কৃতি কর্মীদের কোন কার্যক্রম চোখে পড়ে না। সুস্থ ও নিরাপদ সমাজ গঠনে সংস্কৃতি কর্মীদের ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিয়ে উৎসাহিত করতে হবে। ধর্ষণ কোন সুস্থ মানুষের কর্ম হতে পারে না। ধর্ষণে মাধ্যমে যৌন ক্ষুধা মিটেনা তবে একজন মানুষের জীবনকে অস্বাভাবিক করে দিতে পারে অনায়াসেই।
আজ এই মুহূর্তে সকল প্রকার নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিচার সুনিশ্চিত করতে হবে যেমনটা করা হয়েছে ফেনীর নুসরাতের কেইসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর ধর্ষকদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে মৃত্যুদন্ড কায়েম করাই এখন নিরাপদ ও সুস্থ সমাজ গঠনে রাখতে পারে অগ্রনী ভূমিকা।
লেখক : কলামিস্ট।
এইচআর/এমকেএইচ