আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) দুর্নীতি ও অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক বেতন কাঠামোর আওতায় প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন শীর্ষ কর্মকর্তা পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতি হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত বাছাইকরণ পদ্ধতি ছাড়াই যোগ্যতম জনবল নিয়োগের নামে কথিত বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতিসাধিত হচ্ছে। এ নিয়ে আইসিডিডিআরবির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে।উল্লেখ্য, মুখ্য পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) এর অপসারণসহ নয় দফা দাবিতে মাস তিনেক আগে কর্মী মঙ্গল সংস্থার ব্যানারে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী আন্দোলনে নেমেছিল। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যেই কর্মী মঙ্গল সংস্থার নেতাদের কাছে বিভিন্ন অনিয়ম ও আর্থিক দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত এসে পৌঁছেছে। খুব শিগগিরই তারা আবার আন্দোলনে নামতে পারেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সূত্র মতে, নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠিত হলে আরো কোটি কোটি টাকা লুটপাটের তথ্য বেরিয়ে আসবে। জাগো নিউজের অনুসন্ধানে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির যে সকল অভিযোগ উঠে এসেছে তা নিম্নরুপ : মুখ্য পরিচালন কর্মকর্তা নিয়োগ : আইসিডিডিআরবি মূলত গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও চিকিৎসা সেবার কাজে নিয়োজিত একটি স্বনামধন্য আন্তজার্তিক সংস্থা। সংস্থাটির প্রায় সকল ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এ প্রতিষ্ঠানে মুখ্য পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) পদটি গুরত্বপূর্ণ পদ। এ পদের ব্যক্তিটি একাধারে হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট, ফাইন্যান্স, ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট, সাপ্লাই চেন ম্যানেজমেন্ট, ইনফরমেশন টেকনোলজি, ইনস্টিটিউশনাল ট্রান্সফরমেশন ও লিগ্যাল অফিসের মতো গুরত্বপুর্ণ দফতর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বিজ্ঞানী ও কর্মকর্তা জানান, প্রতিযোগিতামূলক প্রক্রিয়া ছাড়া নির্ধারিত দায়-দায়িত্বের সঙ্গে সংগতিহীন শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন (চারুকলায় স্নাতক ও অ্যাপ্লায়েড বিহেভিয়ারেল সায়েন্সে স্নাতকোত্তর) বিদেশি নাগরিক ইনগ্রিড রিনাউডকে মাসিক ২০ লাখ ৪২ হাজার টাকা বেতনে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ নিয়োগটি যথাযথ, দক্ষ ও নৈতিক হয়নি উল্লেখ করে তারা বলেন, এ নিয়োগের মাধ্যমে বিদেশিদের স্বজনপ্রীতি, জাতীয়তাপ্রীতি ও বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ও ব্যবস্থাপকদরি বিরুদ্ধে বৈষ্যম্যমূলক আচরণ ফুটে উঠেছে। পরিচালক, মানব সম্পদ নিয়োগ :অনুসন্ধানে জানা গেছে, আইসিডিডিআরবির নিয়োগবিধি অনুসারে একমাত্র নির্বাহী পরিচালক ছাড়া (৬৫ বছর) বাকি সকল দেশি-বিদেশি কর্মকর্তার চাকরির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৬০ বছর। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির মানবসম্পদ পরিচালক হিসেবে ক্রিস্টিন ডেনহি নামে কর্মকর্তাকে (যিনি পেশায় একজন নার্স ছিলেন) নিয়োগ দেয়া হয়েছে যার বয়স ৬০ বছরের বেশি। শুধু তাই নয়, পদটিতে যোগদানের ন্যুনতম যোগ্যতা হিসেবে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে (৩০ এপ্রিল ২০১৪) মাস্টার্স ডিগ্রিসহ অন্যান্য যোগ্যতা থাকার পূর্বশর্ত পূরণের কথা বলা হলেও কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে বিজ্ঞপ্তি পরিবর্তন করে অনার্সসহ (মাস্টার্স ডিগ্রিদের অগ্রাধিকার) অন্যান্য যোগ্যতা চাওয়া হয়। শুধুমাত্র পছন্দের কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিতে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিজ্ঞপ্তিতে পরিবর্তন আনা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। পরিচালক, ফ্যাসিলিটিজ ম্যানেজমেন্ট:সংস্থার দালান-কোঠা, ক্রয় বিক্রয় ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দেখভাল করার জন্য একজন বিদেশি নাগরিককে আন্তর্জাতিক বেতন কাঠামোর অধীনে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অথচ এপদে নিয়োগের জন্য দেশেই অনেক শিক্ষিত, দক্ষ ও অভিজ্ঞ বাংলাদেশি নাগরিক রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির উচ্চপদস্থ অবৈজ্ঞানিক পদসমূহে বাংলাদেশি দক্ষ জনবল নিয়োগ দয়া হলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হতো। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অবৈধ নিয়োগ- কোটি টাকার কমিশন বাণিজ্য:মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিচালক পদে নিয়োগ সম্পর্কে খোঁজ নিতে গিয়ে আরো জানা যায়, ক্রিস্টিন ডেনহি আইসিডিডিআরবির শীর্ষ পর্যায়ে নিয়োগের জন্য বিদেশি জনবল খুঁজে দেয়ার নামে “এসআরআই এক্সিকিউটিভ সার্চ” নামক আয়ারল্যান্ডভিত্তিক একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে নানা অজুহাতে কোটি কোটি টাকার কমিশন পরিশোধ করছেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, এসআরআইকে এপর্যন্ত বিভিন্ন নিয়োগের কমিশন বাবদ প্রায় এক কোটি ৪৯ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৩ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের নামে “হ্যাকেট গ্রুপ” নামক অপর একটি বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটিকে এ পর্যন্ত পাঁচ কোটি ৭১ লাখ ছয় হাজার ৪৮৮ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আইসিডিডিআরবির প্রকিউরমেন্ট পলিসি অনুযায়ী এ ধরনের কোনো বিদেশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক উন্মুক্ত বাছাইকরণ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। উপরোল্লিখিত দু’টি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিওও নিজেই তার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, নিয়োগ ও পরামর্শ ফি বাবদ এসআরআইকে ৭৫ লাখ ৪৪ হাজার ৯২২ টাকা পরিশোধ করেছেন। অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, আইসিডিডিআরবি সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী বোর্ড অব ট্রাস্টি (বিওটি) এর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আড়াই লাখ ডলারের বেশি খরচের ক্ষেত্রে বিওটির অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু এসআরআইকে কমিশন বাবদ তিন লাখ ডলার প্রদান করার ক্ষেত্রে বিওটির অনুমোদন নেয়া হয়নি।আইসিডিডিআরবি কর্মী মঙ্গল সংস্থার মহাসচিব ড. ফিরোজ আহমেদ বলেন, হ্যাকেট ও এসআরআই-এর মাধ্যমে সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট এবং জনবল নিয়োগর নামে কোটি কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতিসাধিত হচ্ছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। তিনি জানান, বর্তমান মানবসম্পদ পরিচালক আইসিডিডিআরবিতে ফেলো (মার্কস কোম্পানির) হিসেবে অনেক আগে থেকেই কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সিওও-র “জ্যেষ্ঠ পরামর্শক” হিসেবে নিয়োগ পান। যিনি আগে থেকেই আইসিডিডিআরবিতে কর্মরত এবং তার সম্পর্কে কমবেশি সকলেই জানেন তাকে নিয়োগ বাবদ পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে হাজার হাজার ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে। ডাইরেক্টর রিপ্রোডাকশন!ডাইরেক্টর রিপ্রোডাকশন নামে একটি পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য এসআরআই নামক প্রতিষ্ঠানকে ২৯ লাখ ৭২ হাজার ৩০২ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আইসিডিডিআরবিতে এ নামে কোনো পদই নেই। ডাইরেক্টর রিপ্রোডাকটিভ হেলথ নামে একটি পদ থাকলেও বর্তমানে সে পদটিতে খালি রয়েছে। অথচ ওই পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাবদ ৮ লাখ ৬৬ হাজার ২৫০ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে।বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আইসিডিডিআরবির অবৈজ্ঞানিক উচ্চপদে (মুখ্য পরিচালন কর্মকর্তা, পরিচালক মানব সম্পদ ও পরিচালক উন্নয়ন) তারা সকলেই নির্বাহী পরিচালকের বন্ধু অথবা পূর্ব পরিচিত (ইন্টারন্যাশনাল ভ্যাকসিন ইনস্টিটউট কোরিয়াতে এক সঙ্গে কাজ করেছেন)। এরা সকলে মিলে নিয়োগের নামে এসআরআই কোম্পানিকে মোটা অঙ্কের টাকা দিচ্ছেন। দেশীয়ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া করতে দেয়া হলে অর্থ সাশ্রয় হতো।# বিক্ষোভে উত্তাল আইসিডিডিআরবি# দুর্নীতি-অনিয়মের আখড়া আইসিডিডিআরবি# আইসিডিডিআরবি’র আন্দোলন নিয়ে বিপাকে সরকার# বেতন বাড়ছে আইসিডিডিআরবি`র কর্মকর্তা-কর্মচারীদের!# আইসিডিডিআরবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে প্রাণনাশের হুমকি# আইসিডিডিআরবি’র চলমান আন্দোলনের নেপথ্যের কারণএমইউ/একে/আরআইপি/
Advertisement