জাতীয়

প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন ‘শূন্য’, ‘বৈষম্য’র অবসান চায় পুলিশ

২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল। ৪ বছরে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রায় অর্ধশতাধিক দাবি তুলে ধরে পুলিশ। প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি দাবি শোনার পর এগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের আশ্বাস দেন। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরকে এসব দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে সরকারপ্রধান দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার কথা বললেও একটি ছাড়া কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। এ নিয়ে সরাসরি অসন্তোষ প্রকাশ না করলেও প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চান পুলিশ কর্মকর্তারা।

Advertisement

বাংলাদেশ পুলিশের কল্যাণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পুলিশ কয়েকটি দাবি জানিয়েছিল। সেগুলো বাস্তবায়নে তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তবে সেগুলোর একটিও বাস্তবায়িত হয়নি ওই বছরের ডিসেম্বর পেরিয়ে গেলেও। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর জন্য একটি স্পোর্টস ট্রেনিং কমপ্লেক্স তৈরির দাবি জানানো হয়েছিল। তবে পুলিশ সদরদফতরের ডেভেলপমেন্ট-২ শাখা সবেমাত্র উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) প্রণয়নের কাজ করছে। ডিপিপি তৈরির পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এরপর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যাবে এই প্রস্তাব। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা ধরেই নিয়েছেন, সহসা নিজস্ব স্পোর্টস কমপ্লেক্স পাচ্ছে না পুলিশ।

একই বছর পুলিশ সদস্যদের পরিবারের আজীবন (দুই সদস্যের, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত) পারিবারিক রেশন সুবিধা চাওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুলিশের এই প্রস্তাব মেনে নেন। তবে বর্তমানে এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-২ শাখায় আটকে আছে। এছাড়াও ‘দুষ্কৃতিকারী কর্তৃক আক্রান্ত হয়ে (Killed in action on duty)’ মৃত্যুবরণকারী কর্মকর্তাদের পারিবারিক রেশন দেয়া হলেও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিহত হওয়া কর্মকর্তাদের এই সুবিধা পান না। যদিও তাদেরও এই সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, তবে তা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

২০১৯ সালে পুলিশের বিশেষ ভাতা যৌক্তিক পর্যায়ে উন্নীতকরণের কথা থাকলেও এই প্রস্তাবটিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-২ শাখায় ঝুলে আছে।

Advertisement

পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, দীর্ঘদিনের দাবির পর অর্থ বিভাগ রাজশাহীর সারদার পুলিশ একাডেমি ও মিরপুরের স্টাফ কলেজে কর্মরত ও পদায়িত বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারদের শর্তসাপেক্ষে ৩০ শতাংশ প্রশিক্ষণ ভাতা দিতে সম্মতি জানায়। এছাড়া জাতীয় বেতন স্কেল-২০১৫ অনুযায়ী বিভিন্ন প্রকার ভাতা বৃদ্ধিকরণের প্রস্তাব মেনে নেয় সরকার। তবে এটিও বাস্তবায়িত হয়নি। এটিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ-২ শাখায় আটকে আছে। পুলিশ ৩৬৫ দিনে ২৪ ঘণ্টা করে দেশের নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে। অথচ সরকারি সব পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ ভাতা পেলেও পুলিশের কেবল বিসিএস ক্যাডারদের ভাতা দেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত বৈষম্যমূলক।

কর্তব্যরত অবস্থায় একজন পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু হলে তিনি ৫ লাখ টাকা পান। অথচ চাকরিরত অবস্থায় (ছুটিতে থাকলেও) কোনো সরকারি কর্মকর্তা যদি মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে তাকে ৮ লাখ টাকা দেয়া হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা এটিকে ‘চরম বৈষম্যমূলক’ বলে মনে করেন। এবারের পুলিশ সপ্তাহে এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তারা আলোচনা করবেনও বলে জানান।

পুলিশ সদস্যদের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নতির জন্য ২০১৭ ও ২০১৮ সালে রাজারবাগের কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালকে ১০ তলা ভবন করার প্রস্তাব ছিল পুলিশের। সরকার এই প্রস্তাবনা মেনে নিয়েছিল। তবে সর্বশেষ ২ জানুয়ারি এই প্রস্তাবের অগ্রগতি জানতে চাইলে মন্ত্রণালয় জানায়, ‘বর্তমানে উক্ত প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি কাজের জন্য কনসালট্যান্ট নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন।’

একই বছর পুলিশের এসআই, সার্জেন্ট ও এএসআইদের সরকারি কাজে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ক্রয়ে স্বল্প সুদের কিস্তির বা ঋণের প্রস্তাব ও জ্বালানি ভাতা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। তবে দুই বছর পেরিয়ে গেলেও এটি আটকেই আছে পুলিশের ট্রান্সপোর্ট ও অডিট শাখায়। যদিও পুলিশের কমিউনিটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার কারণে বাহিনীর সদস্যরা সেখান থেকে নিজ উদ্যোগে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করছেন।

Advertisement

অনেক কর্মকর্তা যোগ্য হলেও পদ না থাকার কারণে তাদের পদোন্নতি দেয়া যাচ্ছে না বলে কথা উঠেছিল। সেজন্য পুলিশের উচ্চ পর্যায়ে পদ সৃষ্টির জন্য ২০১৮ সাল থেকেই দাবি তোলা হয়েছে। এই কার্যক্রম ‘চলমান’, পুলিশ সদরদফতর এমন মন্তব্য করলেও ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত পদ সৃষ্টি করা হয়নি।

৩ বছর আগে পুলিশে পাঁচটি পদকে গ্রেড-১ পদ অনুমোদনের দাবি করা হয়েছিল। সেই দাবি মেনে নেয়া হলেও বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ৫টি পদের মধ্যে অ্যাডিশনাল আইজি (এঅ্যান্ডও) এবং অ্যাডিশনাল আইজি-এসবিকে গ্রেড-১ পদে উন্নীত করা হয়। র‌্যাব ডিজি, সিআইডির সাবেক অ্যাডিশনাল আইজি, সাবেক ডিএমপি কমিশনারকে উন্নীত করা হয় নিউমারারি (গ্রেড-১) পদে।

আগামী ৫ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হবে। এই সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে আবারও বসবেন পুলিশের কর্মকর্তারা। তবে ৩-৪ বছর আগের দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলো বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশ তারা।

দাবি-দাওয়ার বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা না বললেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় থাকাবস্থায় পুলিশের অনেক উন্নয়ন করেছেন। পুলিশের সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েছেন। আমরা যখনই তার কাছে আমাদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়া তুলে ধরি, তিনি সঙ্গে সঙ্গে এগুলো বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। তবে এগুলোর অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয় না, নানা কারণে নানা মন্ত্রণালয়ে আটকে যায়। অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পুলিশের অনেক বৈষম্য রয়েছে। বৈষম্য দূর করতে আমরা কয়েকবছর ধরে কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরছি। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এগুলো বাস্তবায়ন দরকার।’

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের আগে পরিদর্শক থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইউনিফর্ম কেনার টাকা দিত সরকার। ২০১৭ সালে পরিদর্শক থেকে শুরু করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বছরে দুটি পোশাক দেয়ার আহ্বান জানায় পুলিশ। এই দাবিটি মেনে কয়েকবছর ধরে তাদের দুটি ইউনিফর্ম দেয়া হচ্ছে। এটিই একমাত্র দাবি যা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে। এছাড়া কোনোটিরই তেমন অগ্রগতি নেই।

পুলিশের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতির বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে ফোন করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। মন্ত্রী এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

জানতে চাইলে পুলিশ সদরদফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো এবারও পুলিশ সপ্তাহ অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৫ জানুয়ারি থেকে। পুলিশ সদস্যরা প্রতিবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজেদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়াগুলো তুলে ধরবেন।’

এআর/এইচএ/এমএস