মতামত

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে স্বচ্ছতার প্রশ্ন

নতুন বছর ২০২০ এর ৩০ জানুয়ারি ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী আন্দোলন এই নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী দিয়েছে।

Advertisement

জাগো নিউজ রিপোর্ট করেছে- দুই সিটি কর্পোরেশনে মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত নারী আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য এক হাজার ৩৯ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এর মধ্যে দুই সিটিতে ১৪ মেয়র প্রার্থী রয়েছেন। উত্তর সিটিতে মেয়র পদে জমা দিয়েছেন- আওয়ামী লীগের আতিকুল ইসলাম, বিএনপির তাবিথ আউয়াল, জাতীয় পার্টির জি এম কামরুল ইসলাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাজেদুল হক, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) শাহীন খান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ফজলে বারী মাসউদ এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) আনিসুর রহমান দেওয়ান।

দক্ষিণে মেয়র পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের শেখ ফজলে নূর তাপস, বিএনপির ইশরাক হোসেন, জাতীয় পার্টির হাজী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, ইসলামী আন্দোলনের মো. আবদুর রহমান, এনপিপির বাহরানে সুলতান বাহার, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. আকতার উজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লা ও গণফ্রন্টের আব্দুস সামাদ সুজন। ইসি ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ জানুয়ারি। প্রতীক বরাদ্দ হবে ১০ জানুয়ারি।

আওয়ামী লীগের উত্তরের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম পুনরায় ঢাকা উত্তরের মেয়র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র আনিসুল হকের মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে জয়ী হয়ে আতিক এক বছরের কম সময়ের জন্য মেয়র ছিলেন। অল্প কিছুদিনের মেয়র তাই সুনাম-দুর্নাম তেমন কিছু করাও সম্ভব হয়নি। তবে সুযোগ পেলেই টাকা রোজগারের যে প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে দেখা দিয়েছে তা থেকে আতিক মুক্ত ছিলেন বলা যায়। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদ টাকা রোজগারের জন্য খুবই লোভনীয় পদ। দুই হাতে টাকা কুঁড়ানো যায়। অল্প দিনের জন্য হলেও মেয়র আতিকুল ইসলাম টাকার পাপাচার থেকে নিজেকে ঊর্ধ্বে রাখার চেষ্টা করেছেন বলে শুনেছি। ক্ষমতার আসন মানুষের জন্য বড় পরীক্ষার ক্ষেত্র। এখানে বসলে মানুষ অহংকারী হয়, দুরাচার করার চেষ্টা করে।

Advertisement

ঢাকাবাসী নির্বাচিত মেয়র হিসেবে মোহাম্মদ হানিফ এবং সাদেক হোসেন খোকাকে পেয়েছিলেন। তারা ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা সিটির মেয়র। দুর্নীতি আর ব্যর্থতার অভিযোগ দুইজনের বিরুদ্ধে ছিল। উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান তারা ঢাকাবাসীকে দেখাতে পারেননি। সর্বশেষ বিভক্ত ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে উত্তরে আনিসুল হক এবং দক্ষিণে সাঈদ খোকন নির্বাচিত হয়েছিলেন। অতি অল্প সময়ে আনিসুল হক তার কর্মদক্ষতা দিয়ে ঢাকা উত্তরের বাসিন্দাদের মন কেড়ে নিয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে হারাতে হয়েছে তার অকালমৃত্যুর কারণে।

অন্যদিকে দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন, যিনি ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মেয়র হানিফের ছেলে, মেয়াদ পূর্ণ করলেও কাঙ্ক্ষিত সুনাম অর্জন করতে পারেননি। ফলাফল দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়র পদে দলীয় টিকিট চেয়েও পাননি বরং দলীয় মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে কান্নাকাটি করে নিজের ইজ্জত খুঁইয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় হাসির খোরাকও হয়েছেন, যা কান্না না করলে এত বিরূপ হতো না মনে হয়।

একসময় চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান, যেটি বর্তমান সিটি মেয়রের অনুরূপ পদ, ছিলেন অ্যাডভোকেট নুর আহমদ। একাক্রমে সুদীর্ঘ ৩৫ বছর তিনি চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন। কখনো কোনো দুর্নাম কুঁড়াননি তিনি। এমন বিরল লোক এখন পাওয়া মুশকিল। আশা করি আগামী নির্বাচনে ঢাকা সিটির নির্বাচিত মেয়ররা অ্যাডভোকেট আহমদের মতো বিরল চরিত্রের লোক হবেন।

যারা প্রার্থী হয়েছেন তাদের অনেকেই সুপরিচিত নন। তবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রার্থী তুলনামূলক পরিচিত। উত্তর সিটি আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আতিকুল ইসলাম একজন ব্যবসায়ী এবং শিক্ষিত লোক। তার পরিবারও মর্যাদাশালী পরিবার। তার এক বড় ভাই তোফাজ্জুল ইসলাম বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পথের কাঁটা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেছিলেন। আরেক বড় ভাই লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইনুল ইসলাম বিজিবির প্রধানসহ সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন।

Advertisement

আতিকের প্রতিদ্বন্দ্বী তাবিথ আউয়াল। তিনি বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বর্তমানে বিএনপি নেতা আব্দুল আউয়াল মিন্টুর ছেলে। আব্দুল আউয়াল মিন্টু কখনো ক্ষমতায় ছিলেন না। তাবিথ আউয়ালও কখনোই ক্ষমতায় ছিলেন না। সুতরাং তাদের কারও কোনো দুর্নাম নেই। এর আগে আনিসুল হকের সঙ্গে তাবিথ আউয়াল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। বিপুল পরিমাণ ভোটও পেয়েছিলেন। কিন্তু নির্বাচনের দিন আধাবেলা না যেতেই তাবিথ দলীয় নির্দেশে নির্বাচন থেকে তার নাম প্রত্যাহার করেছিলেন। সেই ঘটনা মানুষ ভুলে যায়নি। সেই কারণেই হয়তো তাবিথ আউয়াল বলেছেন, নির্বাচনী প্রক্রিয়া থেকে তিনি এবার সরে যাবেন না, শেষ দেখে ছাড়বেন। সরকার যদি নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থেকে সরে যেতে উসকানিমূলক কাজও করে তারপরও থাকবেন।

দক্ষিণে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির ছেলে। ক্ষমতাসীনদের পরিবারের একজন। তাপস দীর্ঘদিন ধরে ধানমন্ডি-কলাবাগান আসনের এমপি হিসেবে ক্লিন ইমেজ রক্ষা করে চলছেন। মেয়র প্রার্থী হতে তিনি সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। ঢাকা দক্ষিণের আসনে খোকনের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের হাতে ক্লিন ইমেজের সুপরিচিত প্রার্থী তাপস ছাড়া খুব কমই ছিল। অবশ্য কেউ কেউ যুক্তি দিচ্ছেন, এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পুরান ঢাকার কেউ হলে ভালো হতো। কিন্তু নিশ্চয়ই সেটা হাজী সেলিমের মতো প্রার্থী নয়। তাপস হাজী সেলিমের তুলনায় ১০০ গুণ উত্তম মেয়র প্রার্থী। অভিজ্ঞ এবং ভদ্র প্রার্থী।

দক্ষিণে তাপসের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির প্রার্থী হচ্ছেন ইশরাক হোসেন। ইশরাক হোসেন সম্প্রতি প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকার ছেলে। রাজনীতিতে এসেছেন সদ্য, ইঞ্জিনিয়ার। তার বাবার পরিচিতি তার যে কাজে আসবে না তা নয়। সুনামে-দুর্নামে সাদেক হোসেন খোকা ঢাকা শহরে ব্যাপক একটা পরিচিত মানুষ। মেয়র থাকাকালে টাকা-পয়সার ব্যাপারে তার দুর্নাম ছিল সত্য তবে হাত বাড়ালে সবাই তাকে কাছে পেতেন বলে মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তাও ছিল। পুরান ঢাকার মানুষের কাছে খোকার যে জনপ্রিয়তা তার সুবিধা পেতে পারেন অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রার্থী ইশরাক।

জাতীয় পার্টি যে দুইজন প্রার্থী দিয়েছে তারমধ্যে উত্তরে প্রার্থী কামরুলের পরিচিতি নেই বললেই চলে। দক্ষিণের প্রার্থী হাজী মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন সারা বছর কারণে-অকারণে পোস্টার দিয়ে ঢাকা শহরের দেয়াল ঢেকে ফেলার জন্য একজন হাস্যকর চরিত্র হিসেবে পরিচিত। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদ বেঁচে নেই। দলীয় মার্কা দিয়ে এবার তাদের বাক্সে কয়টা ভোট পড়ে সন্দেহ আছে।

প্রার্থীদের মধ্যে আমি বরং ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীকে তৃতীয় স্থানে ধরে রাখছি। বিগত কয়েকটি নির্বাচনে তাদের প্রার্থীরা ভালো ভোট পেয়েছিলেন। চরমোনাই পীরের অনুসারী এবং জামায়াতবিরোধী ইসলামী দল যারা পছন্দ করেন তারা তাকে ভোট দিতে পারে।

স্বচ্ছ নির্বাচন নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন এখনই। তবে স্বচ্ছ নির্বাচন হলে নির্বাচন খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হবে- এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্বাচন স্বচ্ছ হবে কিনা এই নিয়ে নানা জনের নানা উদ্বেগ থাকলেও আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস যে, যেহেতু নির্বাচনটি এবার ইভিএমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে স্বচ্ছতার কিছুটা হলেও নিশ্চয়তা আছে। যদিও বিএনপি ইভিএম নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে। আমি বলব, যদি বিএনপি এই নির্বাচনকে সিরিয়াসলি নিয়ে থাকে এবং কোনো নাটক না করে তাদের প্রার্থীরা ভালোও রেজাল্ট করলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

রাজনীতিতে বিএনপির ভূমিকা অপদার্থের মতো। সাহসী কোনো ভূমিকা রাখতে গত ১১ বছর বিএনপি নেতৃত্ব ব্যর্থ হয়েছে। তাদের নিজস্ব কোনো গুণাগুণ না থাকলেও আওয়ামীবিরোধী জনগোষ্ঠী তাদের সঙ্গেই রয়েছে- যাওয়ার কোনো বিকল্প জায়গা নেই বলে। সুতরাং সুযোগ পেলে আওয়ামীবিরোধী শক্তি এবং ভাসমান সমর্থকদের ভোট তাদের প্রার্থীর পক্ষে যাবে।

আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় আছে। স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ আরও বেশি হয়েছে। উন্নয়ন এবং শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্ব তাদের প্রধান সম্বল। সরকারদলীয় প্রার্থী জিতলে উন্নয়নের পথে বাধা হবে না- এটি অনেক ভোটার বিশ্বাস করেন। তবে উন্নয়নের যত কথাই বলি না কেন, এদেশের ভোটাররা ভোটে উন্নয়নকে খুব কমই বিবেচনা করে। তারা হুজুগে এবং আবেগে চলে। দলীয় অন্ধত্ব এখানে খুবই প্রকট। দ্বিতীয়ত এটি জাতীয় নির্বাচনও নয় যে বিরোধী দল জিতলে সরকারের পতন হবে। বিএনপির কর্মী গোষ্ঠীর অভাব নেই। সবাই আন্তরিকভাবে কাজ করলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করা কঠিন হবে না।

তবে শেষ দেখার জন্য একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আমাদের। আর স্বচ্ছ নির্বাচন অনু্ঠানে নির্বাচন কমিশন, সরকার এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর ভূমিকা সবার আগে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com

এইচআর/বিএ/জেআইএম