মতামত

আবার জমবে খেলা

রাজধানীর গুলশানে কূটনৈতিক পাড়ায় ইতালির নাগরিক, এনজিও কর্মী তাভেলা সিজার হত্যার বেশ ক’দিন পার হয়ে গেল। আইন শৃঙ্খলা বাহিনি এখনো তেমন কোনো ক্লু বের করতে পারেনি। তবে বেশ কিছু সম্ভাব্যতা ধরে তদন্ত কাজ চলছে বলে আমরা জানলাম।  যে স্থানটিতে এই নিরীহ বিদেশী ভদ্রলোককে খুন করা হয়েছে সেটি ঢাকা শহরের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকার একটি। মোটরসাইকেলে করে এসে জগিংরত তাভেলাকে গুলি করে মেরে নির্বিঘ্নে চলে যাওয়া আমাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গালে যে একটা বড় চপেটাঘাত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আশা করা যায় এই রহস্যের জাল উন্মোচিত হবে, যেমনটি হয়েছিল সৌদি দূতাবাসের কর্মকর্তা খুনের ঘটনায়।বাংলাদেশের মানুষের খুব কমই আনন্দের উপলক্ষ থাকে। নানা নেতিবাচক পরিস্থিতিতেও ক্রিকেট আমাদের দলমত নির্বিশেষে এক আনন্দ উপকরণ। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল বাংলাদেশে আসবে, এক ধরনের উচ্ছ্বাস আর আনন্দের মাঝে ঈদ উদযাপন চলছিল। কিন্তু সবকিছু ম্লান করে টিভি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ ভেসে উঠল, “নিরাপত্তার কারণে বাংলাদেশে আসছেনা অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দল”। সবাই যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। ক্রিকেট কর্তারা, সরকারের উচ্চ পর্যায়ে থাকা মানুষেরা যেমন হতচকিত হয়েছেন, তেমনটাই হয়েছেন সাধারণ নাগরিকরাও। একটা প্রশ্ন সর্বত্র উচ্চারিত হতে থাকে কি এমন হয়েছে? কিসের ভিত্তিতে অস্ট্রেলিয়া বলছে যে, এখানে নিরাপত্তা সংকট আছে? সাদাচোখে তেমন কিছুই দেখছে না কেউ। বিশ্বাস করতে পারছে না। সামাজিক মাধ্যমে হতাশার কথাই শুধু উচ্চারিত হতে থাকলো।  এমন এক অবস্থায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার নিরাপত্তার কর্মকর্তারা এলেন, কথা বলে চলেছেন ক্রিকেট বোর্ড, সরকার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে। আর যখন আমরা তাদের সব ধরনের আশ্বাস দিতে থাকলাম, তখনই সোমবার সন্ধ্যায় ঘটলো এক অবিশ্বাস্য ঘটনা, কূটনৈতিক পাড়া গুলশানে গুলিতে খুন হলেন ইতালীয় নাগরিক তাভেলা সিজার। কারো আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, এ ট্যুর আর হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর জাতিসংঘে পরিবেশ, টেলিযোগাযোগ, বিশ্বশান্তি বিষয়ে পুরষ্কার গ্রহণ আর বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসার মাঝেই বিদেশিরা এলার্ট জারি করল তাদের নাগরিকদের জন্য, যেন বাংলাদেশে চলাফেরায় তারা সতর্ক থাকে। এই এলার্ট এমন এক সময় এলো যখন খোদ যুক্তরাষ্ট্রের জরিপকারী প্রতিষ্ঠান গ্যালাপের `বৈশ্বিক আইন-শৃঙ্খলা সূচক-২০১৫`  প্রতিবেদন বলছে বাংলাদেশের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের চেয়েও ভালো। এ তালিকায় বাংলাদেশের স্কোর ৭৮ এবং একই পর্যায়ে রয়েছে জাপান ও নিউজিল্যান্ডের মতো উন্নত দেশও। সার্কভুক্ত পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল ও ভুটানও রয়েছে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা ও অপরাধ পরিস্থিতির বিবেচনায় বাংলাদেশের পেছনে। সরকার অস্ট্রেলীয় দলকে `ভিভিআইপি` নিরাপত্তা ব্যবস্থার আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু সেই আশ্বাস তারা কানে তুলবে না তা নিশ্চিত ছিল এবং বৃহষ্পতিবার পরিষ্কার করে বলা হলো, ট্যুর বাতিল। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের পাবলিক ফাংশন বন্ধ রেখেছে, একদিন বন্ধ ছিল ঢাকাস্থ আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং আমেরিকা ক্লাব। বৃটিশ আর আমেরিকানদের অনুসরণ করে এমন এলার্ট জারি করল দক্ষিণ কোরিয়াও।   মানুষের কাছে নিরাপত্তা সংকটের বিষয়টি অবিশ্বাস্য লেগেছে একারণে যে ঈদ-উল আযহার  এই সময়টায় লাখ লাখ নারী-পুরুষ নির্বিঘ্নে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটে গেছেন পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে উৎসব পালন করতে। পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে উপচেপড়া ভিড়। কোথাও আইন-শৃঙ্খলা লঙ্ঘনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু হঠাৎই সোমবার সন্ধ্যায়  সব উল্টে গেল। তবে কি তা পরিকল্পিত ভাবেই করা হলো যাতে ক্রিকেট বাতিল হয়? যারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে সচেষ্ট তারাই কি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ যেমন পাকিস্তানে নিষিদ্ধ সেই পর্যায়ে নিতে চায় বাংলাদেশকেও? এসবই শুধু প্রশ্ন বা আন্দাজ। তাভেলা সিজার হত্যায় জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর দাবিকে খুব একটা আমলে নেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু  বিদেশি নাগরিককে গুলি করে হত্যার ঘটনাটিকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখারও সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। যারা ঘটনা ঘটিয়েছে তারা হিসেব নিকেশ করেই বিদেশি নাগরিক খুন করেছে যেন সেরকম সাড়া পড়ে, বিদেশিরা আতংকিত হয়। বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য কোনো স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর চক্রান্ত আছে বলে মনে করছে সরকার। আর সে কারণেই জোর তৎপরতা দরকার। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী প্রকৃত দোষীদের ধরতে পারবে এটা প্রত্যাশিত, তবে সময় যেন খুব বেশি চলে না যায়। সাধারণের মনে কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। গুলশানের কূটনৈতিকপাড়া পুলিশের কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে থাকে সবসময়। সেখানে কীভাবে এমন ঘটনা ঘটলো? হত্যাকারীরা কীভাবেই বা নির্বিঘ্নে পালিয়ে গেল?  খুনের ঘটনাটি বিদেশি কূটনীতিকদের নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিয়ে তুলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু উদ্বিগ্ন আমরাও। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট দল নির্বিঘ্নে বাংলাদেশ সফর করে গেলো, হঠাৎ কী এমন ঘটলো যে, অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফরে আসাকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে?বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে আছে। বিভিন্ন অভিযানে অনেক জঙ্গিকে পাকড়াও করার খবরও গণমাধ্যমে আসছে নিয়মিত। কিন্তু বাংলাদেশ যে, জঙ্গি নাশকতার ঝুঁকিতে আছে তা প্রমাণ করে একের পর এক ব্লগার হত্যা। কিন্তু ইতালির নাগরিকের হত্যাকে দেখতে হবে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে। বাংলাদেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করছে এবং সেটা বিশ্বসমাজেও স্বীকৃত। এর ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো রাখা অপরিহার্য শর্ত এবং সে দায়িত্ব পালন করার মতো শক্তি-সামর্থ্য বাংলাদেশের রয়েছে। বাংলাদেশ ভালো না থাকুক এমন শক্তি দেশের ভেতরে আছে, বাইরে থেকেও ইন্ধন আছে। তাদের পরাভূত করেই এগিয়ে যেতে হবে এদেশকে। আর তাই নাশকতা ও অন্তর্ঘাত বিষয়ে আরো সতর্কতা নেয়া হোক এখন থেকেই। অস্ট্রেলিয়া সরকারের কাছে যেসব তথ্য আছে এই নিরাপত্তা সংকট নিয়ে, আশা করবো তারা বাংলাদেশ সরকারকে তা জানাবে। বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে এসব তথ্য শেয়ার করা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি বিশ্ব শান্তির জন্যই।  তাভেলা সিজার সাধারণ বিদেশি নাগরিক। তার তেমন কোনো কিছুর সাথে জড়িত থাকার কথা এখনো প্রমাণিত হয়নি। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত এদেশটিতে আছে বহু বাংলাদেশি। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, খুনিদের ধরা পড়া এবং শাস্তি পাওয়ার সাথে সেই মানুষগুলোর ভালো থাকার অনেক কিছু জড়িয়ে আছে। আর আছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তির প্রশ্ন। দ্রুততম সময়ে রহস্যের জট খুলবে, আবার সবকিছু স্বাভাবিক হবে, আবার খেলা হবে উচ্ছ্বাসের সাথে, সেই প্রত্যাশাই সবার।    এইচআর/এমএস

Advertisement