মতামত

রাজনীতিতে বিবেচনাবোধ ফিরে আসুক

আমাদের দেশে সবকিছুই যে রাজনীতিনিয়ন্ত্রিত, কোনো কিছুই যে রাজনীতির বাইরে নেই, সেটা আবার প্রমাণ হলো বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ানোয়। বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের পরস্পরবিরোধী রাজনীতি যে সমঝোতার স্তরে নেই- এটা আমাদের রাজনৈতিক পণ্ডিত-বিশ্লেষকদের অনেকেই বুঝতে চান না। তাই প্রায়ই জাতীয় ইস্যুতে ঐকমত্যের কথা বলা হয়। জাতীয় ইস্যু কোনটি বা কোনগুলো? আওয়ামী লীগের কাছে যেটা জাতীয় ইস্যু বিএনপির কাছে সেটা নয়। আবার বিএনপির ইস্যু আওয়ামী লীগের কাছে নন-ইস্যু।

Advertisement

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির জনসমর্থন প্রায় কাছাকাছি। নির্বাচনে এই দুই দলের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয় মূলত ভাসমান ভোটারদের ভোটে। সে জন্য আমাদের দেশে জাতীয় নির্বাচনে ভাসমান ভোটাররাই আসলে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করেন। দলসমর্থক ভোটারের সংখ্যা খুব একটা কম-বেশি না হওয়ায় এই দুটি দলকে কার্যত দেশবাসীর সামনে বড় ধরনের জবাবদিহিতা করতে হয় না বা পরীক্ষা দিতে হয় না।

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি সমর্থকদের মানসিক গড়নে আবার কিছু পার্থক্য আছে। সরকারে থেকে বা দলগতভাবে আওয়ামী লীগ কোনো ভুলত্রুটি করলে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের অনেকেই তার নিন্দা-সমালোচনা করে থাকেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী ও দলীয়প্রধান শেখ হাসিনার বক্তৃতা-বিবৃতিও অনেক সময় নিন্দা-সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকে না। আওয়ামী লীগ সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও বর্তমান সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত বা কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে থাকেন। কিন্তু বিএনপির সাধারণ সমর্থক ও সমর্থক বুদ্ধিজীবীরাও বিএনপি বা খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমানের কোনো কাজের সমালোচনা করেন না, করবেন না। খালেদা জিয়া যে জেদাজেদির রাজনীতি করেন, তার পেছনে সমর্থকদের এই নিঃশর্ত সমর্থনের বিষয়টি প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে বলে আমার ধারণা।

বেগম খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ- এটা কোনো নতুন কথা নয়। তিনি যখন মুক্ত ছিলেন তখনও তিনি পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন না। তিনি চিকিৎসা নেয়ার জন্য তখন দেশের বাইরেও গিয়েছেন। তখন এটা কেউ ইস্যু করেনি, তাই এটা নিয়ে রাজনীতি হয়নি। দুর্নীতি মামলায় সাজা পেয়ে বেগম জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর তার অসুস্থতার বিষয়টিও রাজনীতির ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপি এবং বেগম জিয়া নিজেই সেটা করেছেন।

Advertisement

কোনো মানুষ অসুস্থ হলে চিকিৎসা নেবেন- এটাই স্বাভাবিক। বেগম জিয়া এখন কারাবন্দি। তাই তাকে চলতে হবে কারাবিধি মেনে। যদি সবকিছু তার ইচ্ছানুযায়ী করা সম্ভব হতো তাহলে আর কারাগারে থাকা কেন? বেগম জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা দেয়া নিয়েও পানি কম ঘোলা করা হয়নি। বেগম জিয়া তার পছন্দের ইউনাইটেড হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও চিকিৎসা নেবেন না বলে জেদ করায় কিছুটা কালক্ষেপণ হয়েছে। এখনও চিকিৎসকরা তাকে পরীক্ষা করে বলছেন, তার কোনো গুরুতর সমস্যা নেই। অথচ বিএনপি বলছে, তার সমস্যা মারাত্মক। তার নাকি প্রাণনাশের নীলনকশা বাস্তবায়ন হচ্ছে!

বিষয়টি শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতে গেল। কিন্তু শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। এখন শুরু হয়েছে চিকিৎসকদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বাকবিতণ্ডা। কোন চিকিৎসক খালেদা জিয়ার চিকিৎসা করাবেন, সেটাও ঠিক করে দেবেন আদালত। হায় রে বিশ্বাসহীনতার রাজনীতি! কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে আমাদের!!

চিকিৎসকের রাজনৈতিক পরিচয় জেনে কি কোনো রোগী তার কাছে চিকিৎসা নিতে যান? নাকি তার সুনাম, হাতযশ ইত্যাদি জেনেই যান? স্বাচিপ-ড্যাব নিয়ে যে টানাটানি এটা কি খুব সুস্থতার প্রমাণ দিচ্ছে? সব মানুষ হয়তো রাজনীতি করেন না, রাজনৈতিক দলের সমর্থক হওয়ায়ও সব মানুষের জন্য জরুরি নয়। তবে সব মানুষই তো কাউকে না কাউকে ভোট দেন। সে হিসেবে কোনো মানুষকেই পরিপূর্ণ রাজনীতিনিরপেক্ষ বলা চলে না। এখন খালেদা জিয়ার জন্য তেমন চিকিৎসক খুঁজে বের করা দরকার যিনি কোনোদিন ভোটকেন্দ্রেও যাননি! এতদিন দাবি ছিল নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে। এখন চিকিৎসাও হতে হবে নির্দলীয়-নিরপেক্ষ চিকিৎসকের অধীনে।

খালেদা জিয়ার চিকিৎসার প্রশ্নেও যারা সরকারের দোষ খুঁজছেন, তারা একবার ভাবুন তো, বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে কি শেখ হাসিনার জন্য তার ইচ্ছামতো চিকিৎসা গ্রহণের সুযোগ দেয়া হতো? হবিগঞ্জের নিভৃত গ্রামে গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া সাহেবকে দ্রুত ঢাকা আনার জন্য একটি হেলিকপ্টার পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি একটি ভালো অ্যাম্বুলেন্সও। যথাসময়ে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে হয়তো কিবরিয়া সাহেবকে ওভাবে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। বিএনপির পক্ষ নিয়ে যারা মানবিকতার দোহাই দিয়ে ওকালতি করেন তারা দয়া করে বিএনপির আমলনামা মনে করার চেষ্টা করবেন। খালেদা জিয়ার আমলে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শেখ হাসিনাকে হত্যার অপচেষ্টা হয়েছে। শেখ হাসিনা বদলার রাজনীতি করলে কী অবস্থা হতো?

Advertisement

এই প্রশ্ন যখন সামনে আসে তখন বলা হয়, বিএনপির খারাপ নজির আওয়ামী লীগ কেন অনুসরণ করবে? বিএনপি অধম হলেও আওয়ামী লীগ কেন উত্তম হবে না? আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বেশি। এই দল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে এই দল। কিন্তু এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, রাজনীতি একটি গণসম্পৃক্ত ব্যাপার। অসংখ্য মানুষের সমর্থন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল চলতে পারে না। তাই নানা মানুষের নানা চাহিদা বা আকাঙ্ক্ষার সমন্বয় ঘটিয়েই চলতে হয় রাজনৈতিক দলকে। নীতি বা আদর্শবাদী রাজনীতির দলগুলো যেভাবে গণবিচ্ছিন্ন থাকতে পারে, ক্ষমতাপ্রত্যাশী দলগুলো তা পারে না। বিএনপি যদি খারাপ কাজ করে জনসমর্থন না হারায় তাহলে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ কেন ভালোটা করতে উৎসাহিত হবে?

না, কাণ্ডজ্ঞান রহিত রাজনীতি আমরা চাই না। আমরা চাই রাজনীতিতে সুবুদ্ধি ফিরে আসুক। বিবেচনাবোধ ফিরে আসুক। হিংসা-প্রতিহিংসা দূর হোক। সবার ওপরে রাজনীতি সত্য না হয়ে সবার ওপরে মানুষই সত্য হোক।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

এইচআর/বিএ/জেআইএম