দুদিন পরই শুরু হচ্ছে নতুন বছর। ২০১৯ সালকে বিদায় দিয়ে বরণ করে নিতে হবে ২০২০ সালকে। ২০১৯ সাল ছিল ঘটনাবহুল একটি বছর। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা অন্যতম। সুনামগঞ্জে পারিবারিক সহিংসতার জেড়ে ধরে খুন হয়েছেন মা, বাবা, ছেলে আবার কেউ আত্মহত্যা করেছেন। ২০১৯ সালে এ রকম মোট সাতটি ঘটনা ঘটেছে সুনামগঞ্জে। দিরাইয়ের শিশু তুহিন হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে হত্যাসহ পারিবারিক সহিংসতা ও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে ঘটেছে নানা ঘটনা।
Advertisement
২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলার মান্নারগাঁও এলাকায় ছেলের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন মা। সৌদি আরব ফেরৎ আফিয়া বেগমের কাছে ছেলে সবুজ প্রায়ই মোটরসাইকেল কেনার জন্য টাকা চাইতো। আফিয়া বেগমের মোটরসাইকেল কিনে দেয়ার সামর্থ না থাকায় ছেলেকে টাকা দিতে পারেননি। এ কারণে ঘরে ডুকে মা আফিয়া বেগমকে হত্যা করে ছেলে। পরে পুলিশ তালাবদ্ধ ঘর থেকে আফিয়া বেগমের মরদেহ উদ্বার করে এবং ছেলে সবুজকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। বর্তমানে সে কারাগারে রয়েছে।
এই ঘটনার কয়েকদিন পর ১১ মার্চ সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলায় ২৭ দিনের শিশুকে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করেন এক পাষণ্ড মা। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহের জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে জানায় পুলিশ। এ ঘটনায় নিহত শিশুর বাবা আব্দুস শহিদ থানায় মামলা করলে পুলিশ তার স্ত্রী ইয়াসমিন বেগমকে আটক করে। পরবর্তী তিনি আদালতে ২৭ দিনের শিশুকে পানিতে চুবিয়ে হত্যার ঘটনা স্বীকার করেন। বর্তমানে ইয়াসমিন বেগম কারাগারে রয়েছেন।
তাছাড়া ৪ জুন রাতে সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায় পলাশগাঁও গ্রামে আপন ভাতিজার ছুরিকাঘাতে খুন হন চাচা। ছাগলের গাছ খাওয়া নিয়ে চাচা শুক্কুর আলীর সঙ্গে তার ভাতিজা সালাউদ্দিনের কথা কাটাকাটি হয়। এর একপর্যায়ে সালাউদ্দিন তার হাতে থাকা ছুরি দিয়ে চাচার পেটে আঘাত করলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ঘটনায় সালাউদ্দিনকে আটক করে পুলিশ।
Advertisement
এদিকে ২০১৯ সালে ৯ আগস্ট রাতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলায় মায়ের বকুনি সইতে না পেরে অভিমানে আত্মহত্যা করে তানবীর সিদ্দীকা তামান্না (১৪) নামে এক স্কুলছাত্রী। ছোট ভাইকে মারধর করায় মা ফিরোজা বেগম তামান্নাকে বকাঝকা করলে সে দুপুরে চাচার বসতঘরের দরজা লাগিয়ে আড়ার সঙ্গে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। পরে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।
অন্যদিকে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ছিল ৫ বছর বসয়ী শিশু তুহিনকে হত্যা। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় গত ১৪ অক্টোবর নৃশংস এ হত্যার ঘটনা ঘটে। বাবা ও চাচার সহায়তায় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে রাতের আড়ালে শিশু তুহিনকে গলা, কান ও লিঙ্গ কেটে হত্যা করে গাছের সঙ্গে মরদেহ ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ সময় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে ছালাতুল ও সোলেমান নাম লিখে তুহিনের পেটে দুইটি ছুরি ঢুকানো হয়। পুলিশ এ ঘটনায় বাবা-চাচাদের আটক করে। আটকের পর পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঘাতকরা স্বীকার করে বাবার কোলেই খুন হয় তুহিন। বর্তমানে ঘাতকরা কারাগারে রয়েছেন।
তার কয়েকদিন পর ৩ নভেম্বর সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজারে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মুক্তিযোদ্ধা স্বামীকে খুন করেন স্ত্রী। উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের বাসিন্দা কালা শাহের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর বারিকের মামলা সংক্রান্ত বিরোধ চলছিল। বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে স্ত্রী আছিয়া বেগম স্বামী আব্দুর বারিককে শাবল দিয়ে আঘাত করে খুন করেন। এ সময় প্রতিবেশীরা ঘটনাটি দেখে পুলিশে খবর দেন। পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে নিহত মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ উদ্ধার করে এবং সেই সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য স্ত্রী আছিয়া বেগমকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। বর্তমানে আছিয়া বেগম কারাগারে রয়েছেন।
সর্বশেষ গত ২১ ডিসেম্বর সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায় পুত্রবধূর লাঠির আঘাতে শ্বশুর সৈইফ উদ্দিন (৬০) নিহত হন। নিহত সৈইফ উদ্দিনের ছেলে শফিক নূরের স্ত্রী সোহেনা বেগম প্রায়ই বড় জার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঝগড়া করেন। এরই অংশ হিসেবে ২০ ডিসেম্বর রাতেও তার সঙ্গে ঝগড়া হয়। এ ঘটনার জের ধরে ২১ ডিসেম্বর ভোরে সোহেনা বেগম বাড়ির পাশে গাছের ডালের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করতে গেলে শ্বশুর সৈইফ উদ্দিন তাকে বাঁচানোর জন্য এগিয়ে যান। এ সময় সোহেনা বেগম হাতে লাঠি নিয়ে শ্বশুরের মাথা ও পেটে আঘাত করলে তিনি ঘটনাস্থলেই নিহত হন। এ ঘটনায় পুলিশ পুত্রবধূ সোহেনা বেগমকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। বর্তমানে তিনিও কারাগারে রয়েছেন।
Advertisement
এ রকম পারিবারিক সহিংসতায় পরিবারের লোকজনের হাতে খুনের বিষয়ে সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জয় তালুকদার বলেন, একজন মানুষ নিজ থেকে খারাপ হয় না। একটি পরিবারের মধ্যে যদি কলহ থাকে, পরিবারের লোকজন যদি খোঁজ খবর না রাখে তাহলে এ রকম ঘটনা আরও ঘটবে। পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা দেয়া অত্যান্ত প্রয়োজন। তাছাড়া বিভিন্ন মামলা মোকাদ্দায় জয়ের জন্য নিজের সন্তান, স্বামীকে খুনের মতো ঘটনা যেনো আর না ঘটে সেজন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
সুনামগঞ্জ মহিলা পরিষদের সভাপতি গৌরি ভট্টাচার্য্য বলেন, পারিবারিক সহিংসতা খুব খারাপ জিনিস। এর জন্য সন্তানকে শিশুকাল থেকেই মানবিক চিন্তার শিক্ষা এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা উচিত। শিশুদের যদি বাড়ন্ত বয়সে এই শিক্ষাগুলো না দেয়া হয় তাহলে তারা পরিবারের কাউকে হত্যা করতে পিছুপা হবে না। আবার সমাজের অন্য কাউকেও খুন করতে গেলেও ভাববে না। আমারা চাই সুনামগঞ্জে যেন এ রকম আর কোনো ঘটনা না ঘটে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি অ্যাডভোকেট নান্টু রায় বলেন, পারিবারিক সহিংসতা রোধে পরিবারেই শিক্ষা দিতে হবে। একটি পরিবারের মধ্যে পারিবারিক শিক্ষা যেমন প্রয়োজন ঠিক তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষারও প্রয়োজন। শিক্ষার হার দিন দিন যতো বৃদ্ধি পাবে ততোই এসব সামাজিক ব্যধি থেকে আমরা মুক্ত হতে পারবো। পারিবারিক সহিংসতা রোধে সামাজিক প্রচারণাও বৃদ্ধি করতে হবে।
আরএআর/পিআর