বিশেষ প্রতিবেদন

প্রচণ্ড বিপদের মধ্যে আছে বাংলাদেশের সীমানা

আলতাফ পারভেজ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষক। বিশ্লেষণ করছেন, লিখছেন আন্তর্জাতিক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। ভারতের নাগরিকপঞ্জি আইন এবং এ আইন ঘিরে ঘটনাপ্রবাহের খবর রাখছেন, বিশ্লেষণ করছেন নিয়মিত।

Advertisement

ভারত প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি মুখোমুখি হন জাগো নিউজ-এর। দীর্ঘ আলোচনায় ভারতের রাজনীতি এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বিষয়েও আলোকপাত করেন তিনি। বলেন, বর্তমান ভারতে বিজেপির যে উত্থান, তা আপাতত ঠেকাতে পারবে না সমসাময়িক আন্দোলন। তবে এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতে নতুন রাজনৈতিক দলের ক্ষুধা তৈরি হয়েছে। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : নাগরিকপঞ্জি নিয়ে আন্দোলন গোটা ভারতেই। কিন্তু উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় যে আন্দোলন হচ্ছে, তা আলাদা করে মূল্যায়ন করা যায় কি-না?

আলতাফ পারভেজ : নাগরিকপঞ্জি নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের আন্দোলন আর দক্ষিণ বা মধ্য ভারতের আন্দোলন একইভাবে মূল্যায়ন করলে হবে না। পুরো ভারতে ক্যাবের (নতুন নাগরিকত্ব আইন) বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র আছে।

Advertisement

আসামে অসমীয়রা বড় বড় আন্দোলন করছে অন্য কারণে। তারা বিরোধিতা করছে এ কারণে যে, ক্যাব হলে প্রচুর হিন্দু বাঙালি আসামে চলে আসবে। অরুণাচলেও তাই। ত্রিপুরায় উপজাতিরা আন্দোলন করছে একই কারণে। আবার পশ্চিমবঙ্গে ক্যাব হচ্ছে মুসলমানদের ভোটকে কেন্দ্র করেই।

পশ্চিমবঙ্গের অনেক হিন্দু আন্দোলন করছে ক্যাব ভারতের সংবিধানের পরিপন্থী বলে। কেরালায় প্রচুর মুসলমান রয়েছে। সেখানে বামপন্থীরা ক্ষমতায়। বামপন্থীরা নীতিগতভাবেই মনে করছে, এনআরসি বা ক্যাব ভারতের বহুত্ববাদের বিপক্ষে। দক্ষিণে প্রচুর তামিল রয়েছে, যারা শ্রীলঙ্কা থেকে এসেছে। তাদের নাগরিকত্ব দেবে না বিজেপি। বলেছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেবে। শ্রীলঙ্কা থেকে আসাদের দেবে না। এ পার্থক্যগুলো বুঝতে হবে।

জাগো নিউজ : শিক্ষার্থীদের আন্দোলন তো এমন পার্থক্য ধারণ করে না…

আলতাফ পারভেজ : শিক্ষার্থীদের আন্দোলন একটি সৎ জায়গা থেকে। বিজেপির এ নাগরিক আইন ভারতের সংবিধান ও বহুত্ববাদের বিপরীতে। শিক্ষার্থীরা এ জায়গা থেকে আন্দোলন করছে।

Advertisement

জাগো নিউজ : স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে আলোচনা আছে। বলছিলেন, আশির দশকের পর এই প্রথম বড় আন্দোলন হচ্ছে সেখানে। এ আন্দোলনে ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হতে পারে কি-না?

আলতাফ পারভেজ : আসাম আসলে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজধানী। ব্যাপক আন্দোলন সেখানে। উত্তর-পূর্বের মানুষ মনে করছে, বিজেপি তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে। ভারতের ভাষায়, বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে এ আন্দোলন শক্তি দেবে।

আবার এ শক্তিগুলো কিন্তু একধরনের বাংলাভাষী বিদ্বেষীও এবং এটা বাংলাদেশের খেয়াল রাখার কথা। বিজেপিবিরোধী এ আন্দোলনে উলফার মতো সংগঠনগুলোতে শক্তি বা জনবল বৃদ্ধি পেতে পারে। উলফা যে রাজনীতির কথা বলে, তা আরও জনভিত্তি পাবে।

কিন্তু একই সঙ্গে একটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে, উলফার রাজনীতি কিন্তু বাঙালি-বিদ্বেষ। আসু’র (নিখিল অসম ছাত্র ইউনিয়ন) যারা বর্তমানে আন্দোলন করছেন, তারা উলফা ও গণপরিষদের প্রথম দিকের সংগঠক। তারা নিরেট বাঙালি-বিদ্বেষ ঘিরেও রাজনীতি করেন।

জাগো নিউজ : বিজেপির জোটে আসাম গণপরিষদও আছে। সেটা কি বাঙালি-বিদ্বেষ থেকেই?

আলতাফ পারভেজ : রাজনীতির হিসেবে অনেক কিছুই মেলে। ক্যাবের কারণে বিজেপি ও আসাম গণপরিষদ অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায়। ‘আসু’ মারাত্মকভাবে শক্তিশালী হতে পারে।

এর মাধ্যমে ভোটের রাজনীতিতে প্রভাব পড়বে। আসু বা অসমীয়দের মধ্যে যারা চরমপন্থী তারা উলফার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। অরুণাচল, ত্রিপুরায় বিজেপির সঙ্গে উপজাতিদের দূরত্ব বাড়বে। বাম সংগঠনগুলো শক্তিশালী হবে। সব মিলিয়ে বলতে হয়, বিজেপির জন্য খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করবে।

জাগো নিউজ : গত এক দশকে উত্তর-পূর্ব ভারতে স্বাধীনতাকামী বা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কোণঠাসা, যাতে বাংলাদেশেরও ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়। উলফার মতো সংগঠন শক্তিশালী হলে বাংলাদেশের জন্য...

আলতাফ পারভেজ : বাংলাদেশের সীমানা এ মুহূর্তে প্রচণ্ড বিপদের মধ্যে আছে। মিয়ানমার সীমান্তে চরম উত্তেজনা মিয়ানমার প্রচণ্ডভাবে ‘বাংলাদেশি-বিদ্বেষ’ অবস্থানে আছে। আসামে ১৯ লাখ মানুষ নাগরিকহারা। বলা হচ্ছে, তারা বাংলাদেশি এবং আসামেও প্রচণ্ড রকমের বাংলাদেশবিরোধী মনোভাব আছে। বাংলাদেশ হাইকমিশনের গাড়ি ভাঙার মধ্য দিয়ে কিন্তু বিশেষ লক্ষণ আমরা বুঝতে পারলাম। তার মানে, এ সীমানায় টেনশন বাড়িয়ে দিল।

পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে আমাদের দীর্ঘ সীমানা। সেখানেও উত্তেজনা। খবরে আসছে, এ সীমানা দিয়ে ভারতীয়রা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। তার মানে, বাংলাদেশের সব দিকেই এখন উত্তেজনা। আমি মনে করি, ক্ষুদ্র দেশ হিসেবে এ পরিস্থিতি প্রচণ্ড রকমের চাপ সৃষ্টি করেছে, গত এক দশকে যে চাপ ছিল না।

জাগো নিউজ : কত দিনের এ ‘চাপ’?

আলতাফ পারভেজ : সহসাই চাপ কমবে বলে মনে করি না। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিও ওলট-পালট হবে। সেখানকার রাজনীতি দারুণভাবে পাল্টে যাবে। আসামে পাল্টানো শুরু করেছে। গাম্বিয়ার মামলার কারণে আরাকানে কী হবে, তা বলা মুশকিল। তবে খারাপ কিছু হবে, তা বলা সহজ।

তার মানে, বাংলাদেশের গোটা সীমানায় এখন উত্তেজনা। বাংলাদেশ সরকার, মানুষ, প্রচার-মাধ্যমের জন্য এটা একটি অগ্নিপরীক্ষা। এ তিন সীমানায় আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা বলা মুশকিল। তবে আমি মনে করি, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রস্তুতির ঘাটতি আছে।

জাগো নিউজ : বিজেপির যে রাজনীতি, তাতে বাংলাদেশ আসলে কী প্রস্তুতিই-বা নিতে পারে?

আলতাফ পারভেজ : বাংলাদেশ ছোট দেশ হতে পারে, কিন্তু সব বিষয়ে তো চোখ-কান বন্ধ রাখার কথা নয়। মিয়ানমারের বিষয়ে বাংলাদেশ আগে কিছুই বলেনি। ১০ লাখ মানুষ প্রবেশ করার পর যখন রোহিঙ্গা বিশ্ব ইস্যু হলো, তখন বাংলাদেশ দৌড়ঝাঁপ শুরু করল।

এএসএস/এমএসএইচ/এমএস