বাংলাদেশ ক্রিকেটের হৃদয় দ্বার কী বন্ধ! নাকি খোলা? প্রশ্নটা অনেকের কাছে অপ্রিয় মনে হতে পারে। সেটা অস্বাভাবিক কিছু না। কারণ, মাঝে মাঝে বাংলাদেশ ক্রিকেটে কিছু জয় অন্যরকম জয়ানুভব দিয়েছে সমগ্র জাতিকে। তাহলে এরকম একটা প্রশ্ন কেন?
Advertisement
হ্যাঁ, প্রশ্ন। কারণ, বাংলাদেশের ক্রিকেট নিয়ে নিঃসংশয় থাকা কঠিন। অন্তত বর্তমান বাস্তবতায়। বঙ্গবন্ধুর নামে বিপিএল হচ্ছে। কিন্তু সেখানে গ্যালারিতে দর্শক ঘাটতি। বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সেও ঘাটতি। পাশাপাশি নেই কোন তরুণের ওঠে আসার ইঙ্গিত। যাকে ঘিরে বলে ওঠা যায়, 'হ্যাঁ, আমরা পেতে যাচ্ছি আগামী দিনের সাকিব-তামিম কিংবা মুশফিকের মত কাউকে!' তাই মন থেকে ভয়, সংশয়, কুণ্ঠা, সন্দেহ মুছে ফেলা কঠিন।
ক্রিকেট পরম্পরা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সঞ্চারিত হওয়ার কথা। কিন্তু সেখানে দেখা যাচ্ছে বিস্তর ফারাক। চলমান বিপিএলে নতুন প্রজন্মের প্রবল, সরব, সতেজ ভূমিকাটা দেখা যাচ্ছে না। যা দেখে ভরসা পাওয়া যায়। ভাবা যায়; বতর্মান প্রজন্মের কোন শুন্যতা তৈরি হবে না আগামীতে বাংলাদেশ ক্রিকেটে। তাই শঙ্কার অবসানের সূচনা দেখা যাচ্ছে না এবারের বিশেষ বিপিএলে। বরং পাশের দেশ ভারতে আইপিএলের নিলামের পর ভয় বেড়ে গেলো। প্রশ্ন উঠে পড়লো; সাকিবের পর কে?
আইপিএলে সাকিব ছাড়া মুস্তাফিজ, রাজ্জাকসহ কয়েকজন বাংলাদেশী ক্রিকেটার খেলেছেন। কিন্তু নিজের দক্ষতা-যোগ্যতায় সাকিব আল হাসান আইপিএলে নিজেকে বাংলাদেশর মুখ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনি-ই বাংলাদেশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক ফেরিওয়ালা। সেই সাকিব বুকিদের ফোনালাপের তথ্য গোপন করায় ক্রিকেটে নিষিদ্ধ। আইপিএলের নিলাম শেষে মনে হচ্ছে; এবার বাংলাদেশও যেন আইপিএলে নিষিদ্ধ। মুস্তাফিজ, মুশফিক কোন দল পেলেন না! বাংলাদেশের কোন ক্রিকেটার থাকলেন না আইপিএলে! এই তথ্যটা আমাদের রুদ্ধকণ্ঠের দ্বারে কড়ানাড়ছে বলেও মনে হয় না।
Advertisement
মুজিব বর্ষ-কে সামনে রেখে এবারের বিপিএল হচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ক্রিকেট মহলের শ্রদ্ধা। সেখানেও শুরুর দিনেই জ্যামাইকার বাঁহাতি পেসার ক্রিসমার সান্তোকির বিখ্যাত-অস্বাভাবিক 'ওয়াইড ও নো বল' বির্তক। বঙ্গবন্ধুর নামে বিপিএলের সঙ্গীও বিতর্ক! বঙ্গবন্ধু নিজে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, 'এক জন বাঙালি হিসাবে যাহা কিছু বাঙালিদের সহিত সম্পর্কিত, তাহাই তাঁহাকে গভীর ভাবে ভাবায়।' সুতরাং তাঁর নামে যে টুর্নামেন্ট সেখানে যদি সামান্য কারণেই বির্তকের ছায়া পড়ে, সেটা বাঙালিকে গভীরভাবে ভাবাবে।
বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক। কিন্তু ক্রিকেট কী একই গতিতে এগুতে পারছে? ভারত, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে চলার পথ তৈরি করেছে। কিন্তু আমরা পারছি কী! পারলে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট লিগে আম্পায়ারিং নিয়ে এতো বির্তক হবে কেন? কেন ঢাকার দলগুলোর গায়ে লেখা হয়ে যায় অফিসিয়াল ক্লাব আর নন অফিসিয়াল ক্লাব!
কেন আম্পায়াররা সেই অফিসিয়ালকে ক্লাবকে উপরের স্তরে তোলার জন্য নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে আঙুল তোলা না তোলার প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবেন! নিচের স্তর, যাকে বার বার বলা হয় তৃণমূল পর্যায়, সেখানেই কেন নীতি-নৈতিকতাহীনতার ছায়া পড়বে? ক্রিকেটীয় শুভ্রতার গায়ে কেন কালির দাগ লাগবে। ফেয়ার ক্রিকেট যদি মাঠে থেকে হাওয়া হয়ে যায়, তাহলে ক্রিকেটীয় বাতাসে দূষণ টের পাওয়া যায়। সেই দূষণের মধ্যে কোন প্রতিভা ওঠে আসতে পারে না। বিকশিত হতে পারে না। আমরা আশাও করতে পারি না। বাংলাদেশে বিপিএলে দেশজ কোন প্রতিভা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আর আইপিএলে মুম্বাইয়ে পানিপুরি বিক্রি করা এক যশস্বী জয়ওয়ালা ক্রিকেটপ্রেমীদের মন জয় করে ফেলেছেন নিলামেই। তার দাম উঠেছে দুই কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। বেস প্রাইস ছিল ২০ লক্ষ টাকা। তাকে পেতে রাজস্থান রয়্যালসকে খরচ করতে হলো বারগুণ বেশি। এর নেপথ্যে ছেলেটার কঠোর পরিশ্রমকেই কৃতিত্ব দিয়েচ্ছেন অনেকে। যশস্বী ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে রয়েছেন। বাঁ-হাতি ওপেনার ঘরোয়া ক্রিকেটে টানা ধারাবাহিকতা দেখিয়েছেন। সেই কারণেই তাঁকে নিয়ে আগ্রহ ছিল নিলামে।
লিস্ট এ ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন যশস্বী। যা এসেছিল ১৭ বছর ২৯২ দিন বয়সে। অক্টোবরে বিজয় হাজারে ট্রফিতে মুম্বাইয়ের হয়ে ঝাড়খণ্ডের বিরুদ্ধে ২০৩ রান করেছিলেন তিনি। এক সময় মাঠে পানিপুরি বিক্রি করেছেন খিদে মেটানোর জন্য। আইপিএল তাকে কোটিপতি বানিয়ে দিল।উত্তর প্রদেশের ভারোহির এক দোকানদারের ছেলে যশস্বী। সেখান থেকে মুম্বাই চলে আসেন তিনি।
Advertisement
মুম্বাইয়ে আসার পরে যশস্বীর লড়াই মাঠের বাইশ গজ থেকে ছড়িয়ে পড়ে জীবনের বাইশ গজেও। এখন নিশ্চয়ই তার স্বপ্নের পরিধি আরো বড় হচ্ছে। সেই ক্ষেত্রটা তাকে করে দিয়েছে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামো। আমাদের স্বপ্ন আটকে থাকে, দুর্বল অবকাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে থাকা ঘরোয়া ক্রিকেটে! তাই আমাদের কোন 'জয়ওয়ালার' খবর আপাতত নেই।
লেখক : সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলাম লেখক।
এইচআর/পিআর