অধ্যাপক এম শাহ্ নওয়াজ আলী। সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সাবেক চেয়ারম্যান, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রগতিশীল শিক্ষক রাজনীতির নেতৃত্ব দিয়েছেন দীর্ঘদিন।
Advertisement
উচ্চশিক্ষার মান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি, ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতির প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনিয়ম-দুর্নীতিরোধে ইউজিসির ক্ষমতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্বারোপ। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : দীর্ঘকাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে সদস্য হিসেবে দায়িত্বে আছেন। উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন। আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কী বলবেন?
অধ্যাপক এম শাহ্ নওয়াজ আলী : একটি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোকপাত করতে গেলে সেখানকার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমলে নিতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-উদ্দেশ্যের সঙ্গে শিক্ষার উদ্দেশ্য গ্রথিত। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষার উন্নয়নে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন।
Advertisement
আমরা দেখেছি প্রধান চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা আর গবেষণার মানোন্নয়নে ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশ করেছেন। কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন, যা ছিল আধুনিক শিক্ষাসমাজের সবচেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক কমিশন। বঙ্গবন্ধু উচ্চশিক্ষা ধারণ করতেন বলেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেছিলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশকে আর সে পথে হাঁটতে দেখিনি। ১৯৭৫ সালের পর যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তাদের কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হোঁচট খায়। আর এতে করে শিক্ষাব্যবস্থায়ও বড় ধাক্কা লাগে।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষার মূলনীতিতে ফিরে আসার চেষ্টা চলে। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ফের ক্ষমতায় আসে এবং ধারাবাহিকতা থাকায় শিক্ষাব্যবস্থায় সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়। উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর যে নিরলস চেষ্টা, তা সত্যিই ঈর্ষণীয় বলতে পারেন।
জাগো নিউজ : যদি ব্যাখ্যা করতেন?
Advertisement
শাহ্ নওয়াজ আলী : দেশে বর্তমানে অর্ধশত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এটি একটি দেশের উচ্চশিক্ষার বিস্তার আর ব্যাপকতাকেই প্রমাণ করে। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠী উচ্চশিক্ষার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে। আপনি চাইলেই রাতারাতি সব পরিবর্তন করতে পারবেন না। সংকট তো তৈরি করা হয়েছিল পরিকল্পিতভাবে। সামরিক সরকারগুলো উচ্চশিক্ষায় নজর না দেয়ার কারণেই সংকট ঘনীভূত হয়। সমস্যা এখনও আছে। বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের প্রধান অন্তরায়।
জাগো নিউজ : ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার সরকারও একযুগ পার করছে। উচ্চশিক্ষায় প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তি কী?
শাহ্ নওয়াজ আলী : আপনি গত এক দশকে উচ্চশিক্ষার দিকে যদি তাকান, দেখবেন, উচ্চশিক্ষায় যে পরিবর্তন এসেছে, তা স্বাধীনতার পর আর হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা এবং গবেষণার পথ প্রশস্ত করেছি। আজ ডিজিটাল বাংলাদেশের যে রূপায়ন ঘটছে, সেখানে প্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার বড় ভূমিকা আছে বলে মনে করি। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।
জাগো নিউজ : আপনি বিশ্বব্যাংকের সহায়তার কথা বলছেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষায় বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশন নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে।
শাহ্ নওয়াজ আলী : যেকোনো কাজেরই আলোচনা-সমালোচনা থাকে। বিজ্ঞান ছাড়া আপনি বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন না। আধুনিক সভ্যতার বিকাশই ঘটছে বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে। আমরা সেই বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাতেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছি। আমরা হয়তো শতভাগ সফল হতে পারিনি। কিন্তু যেটুকু বাস্তবায়ন ঘটছে, তা আশাব্যঞ্জক বলেই বিশ্বাস করি।
জাগো নিউজ : অভিযোগ রয়েছে, বিশ্বব্যাংক সহায়তা দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা বেসরকারিকরণে তাগিদ দিচ্ছে।
শাহ্ নওয়াজ আলী : বিশ্বব্যাংক নিয়ে নানা আলোচনা-সমালোচনা আছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংক যে প্রেসক্রিপশন দিয়েছে, তা এদেশের শিক্ষাবিদ, পরিকল্পনাবিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যের মতের ভিত্তিতেই হয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষার স্বার্থে, এখানকার বাস্তবতার নিরিখেই পরিকল্পনা করা হয়েছে। সহায়তা বিশ্বব্যাংক দিচ্ছে ঠিক, কিন্তু সিদ্ধান্ত এ দেশের শিক্ষার কল্যাণেই হচ্ছে।
জাগো নিউজ : আপনি উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের কথা বলছেন। কিন্তু বিশ্ব র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমশই নিম্নগামী!
শাহ্ নওয়াজ আলী : ঢালাওভাবে এই অভিযোগ বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো অগ্রগামী হওয়া সম্ভব হয়নি। কিন্তু বিজ্ঞান এবং আধুনিক শিক্ষায় যে পরিবর্তন এসেছে, তা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। আর্থ-সামাজিক বা অব্যস্থাপনার কারণে অসঙ্গতি তৈরি হয়নি, তা বলব না। শতভাগ সফলতা আসে না। কারণ মানবজাতি দিয়েই সব পরিচালনা করতে হয়। সবাই সমান না।
জাগো নিউজ : অসঙ্গতি দূর করতে আপনার পরামর্শ কী?
শাহ্ নওয়াজ আলী : সবার আগে নিজের দায়িত্ববোধটা জাগ্রত করতে হবে। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য কী, তা উপলব্ধি করতে হবে। শিক্ষকদের মূল দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষাদান এবং গবেষণায় মন দেয়া। উপাচার্যগণ ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখতে যা করবার, তাই করবে। সরকারের পক্ষ থেকে সকল প্রকার সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা এখানে নিশ্চিত থাকতে পারিনি যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সঠিকভাবে পরিচালনা হয়ে আসছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চায়, আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিশ্বের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে চ্যালেঞ্জ করুক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত বা হস্তক্ষেপ করতে পারে না। মূলত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকার কারণেই নানা ক্ষেত্রে অসঙ্গতি তৈরি হয়। অন্য দেশে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুর কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন। আমাদের দায়িত্ব দেয়া আছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষমতা নেই।
জাগো নিউজ : কেন মনে করছেন?
শাহ্ নওয়াজ আলী : আমরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অর্থবরাদ্দ বা নিয়োগে যাচাই-বাছাই করার ক্ষমতা রাখি। কিন্তু অনিয়ম বা আইনবহির্ভূত কোনো কাজের জন্য ব্যবস্থা নিতে পারি না। দায়িত্ব এবং কর্তৃত্বের মধ্যে সঙ্গতি রাখতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তা নেই বলে মনে করি। মূল দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের হাতে নেই। স্বাধীনতার এত বছর পরও সক্ষমতা না থাকা সত্যিই দুঃখজনক।
জাগো নিউজ : কর্তৃত্ব বলতে আসলে কী বোঝাতে চাইছেন?
শাহ্ নওয়াজ আলী : ধরুন, কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনিয়ম তদন্ত করল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। তদন্তের আলোকে পরামর্শ দিতে পারি আমরা। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আমাদের পরামর্শ অনুসারে অনেক সময় ব্যবস্থা নেয়া হয় না।
জাগো নিউজ : বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে...
শাহ্ নওয়াজ আলী : বহুবার বলা হয়েছে। পাশের দেশ ভারতেই মঞ্জুরি কমিশন স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা রাখে। অথচ, আমরা রাখি না। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন নিয়ে এটি প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন, সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি আজও।
এরপরও আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেশের সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় একটি কাঠামোর মধ্যে আনার পরিকল্পনা চলছে। প্রায় ৩৯ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় অধ্যায়নরত। বিশাল এই পরিমণ্ডলকে রাতারাতি আপনি এক কাতারে আনতে পারবেন না। সময় লাগবে। উচ্চশিক্ষা একটি শৃঙ্খলায় আনতে আমরা বদ্ধপরিকর।
জাগো নিউজ : একটি কাঠামোর কথা বলছেন। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলা হচ্ছে ‘শিক্ষার বাণিজ্য কেন্দ্র’। আপনি কী দেখছেন?
শাহ্ নওয়াজ আলী : শিক্ষার সঙ্গে বাণিজ্য কোনোভাবেই চলে না। শিক্ষা হচ্ছে, একটি জাতির মেরুদণ্ড। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে শিক্ষা বাণিজ্যের অভিযোগ বহু পুরোনো। তারা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে এসে বাণিজ্য করছে বলে মনে করি।
এ কারণেই বলছি, ইউজিসির পক্ষ থেকে একটি সরল কাঠামোর কথা বলা হচ্ছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাকার্যক্রম বিশেষ মাপকাঠিতে মূল্যায়িত হবে। আমরা চাই দেশ, সমাজের উন্নয়নে মানুষ এগিয়ে আসুক। আর এই এগিয়ে আসার অন্যতম একটি পাথেয় হোক উচ্চশিক্ষা। আর বাণিজ্য যেন সেখানে মুখ্য হয়ে না ওঠে।
এএসএস/বিএ/জেআইএম