ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রয়াণে শোকাভিভূত তার স্বজন, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী এবং তার উন্নয়নমূলক কাজের সুফলভোগী মানুষেরা। এই মহাপ্রাণের প্রস্থানে এক আবেগঘন বার্তা দিয়েছেন তার বন্ধু নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
Advertisement
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের পেজে শনিবার (২১ ডিসেম্বর) ‘তুমি আমাদের চিরসাথী’ শিরোনামে ড. ইউনূস লিখেছেন, “আবেদ চলে গেলো। কিন্তু তাকে বিদায় জানানো সম্ভব হবে না। সে আমাদের চিরসাথী হয়ে থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত সে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। সমাজের কোনো পরত নেই যেখানে আবেদের কর্মকাণ্ডের বাতাস লাগেনি। বাংলাদেশে সমাজের যে বিপুল পরিবর্তন হয়েছে আবেদ তার প্রধান রূপকার। সমাজের যত ভাঙাচোরা অলিগলি, চোরাবালি, অলীক নিয়মনীতির ফাঁদ সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল, সবকিছুতে আবেদ তার সৃজনশীল প্রতিভার ছোঁয়া লাগিয়েছে। এই ছোঁয়া লাগিয়ে সবকিছু পাল্টে দিয়ে তাকে নতুন কাঠামোয় নিয়ে আসাই ছিল আবেদের ব্রত।
এটা বললে বোধহয় বাড়িয়ে বলা হবে না যে, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে খুব কম মানুষই আছেন যিনি জীবনে কোনো না কোনোভাবে আবেদের কর্মকাণ্ডের সুফল ভোগ করেননি। আর তিনি যদি হন বিশাল গ্রাম বাংলার দরিদ্রদের একজন, নারীদের একজন, তাহলে তো তাকে জীবনের প্রতি পদক্ষেপে আবেদের সাক্ষাৎ পেতে হয়েছে - শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রোজগার, আত্মোপলদ্ধি, আরও অনেক কিছুতে। আমাদের অজান্তে যে আবেদ আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী, তাকে আমরা বিদায় জানাবো কীভাবে?
আবেদ বাংলাদেশের গরিব মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির অসাধারণ কারিগর। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আর্থিক দৈন্যের মুক্তিদাতা।
Advertisement
সে নীরবে তার বিশাল কর্মকাণ্ড গড়ে তুলেছে। সে মানুষকে ডাক দিয়ে বসে থাকেনি, একাই এগিয়ে গেছে। সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে। সে একাই এগিয়ে গেছে- একেবারে পুরো কাজটা সমাধা করার জন্য।
আবেদ সারা বিশ্বে এনজিও’র কনসেপ্ট বদলে দিয়েছে। একটি এনজিও দেশব্যাপী প্রায় সব সমস্যার সামগ্রিক সমাধান দেয়ার জন্য এগিয়ে আসতে পারবে এরকম ধারণা ছিল একেবারে অকল্পনীয়। দেশে বিদেশে অসংখ্য রকম প্রতিষ্ঠান ও কর্মসূচি নিয়ে একটি বিশালায়তনের এনজিও’র ধারণা আবেদই দিয়ে গেলো। তার চাইতেও তার বড় অবদান একক এনজিও ও বহুমাত্রিক এনজিও’র ব্যবস্থাপনাকে একটা নতুন বিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে যেতে পারা। এই অবদান তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। ভারত পাকিস্তান নেপাল শ্রীলংকার অর্থনৈতিক গবেষকদের কাছ থেকে বরাবরই একটি প্রশ্ন আসে: বাংলাদেশে যে যা-ই করে সেটা দেশব্যাপী করে ফেলে- আমাদের দেশে এরকম হয় না কেন? আমার বরাবরের জবাব ছিল তোমাদের দেশে তো এখনো আবেদের জন্ম হয়নি।
আবেদ একটি আত্মপ্রত্যয়ী বাংলাদেশ তৈরি করে দিয়ে গেছে। তার দুরন্ত সাহস, আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতার কাহিনি আগামী প্রজন্মকে অনবরতভাবে শক্তি যুগিয়ে যাবে। বহু প্রজন্ম পরও আবেদ তাদের কাছে বাংলাদেশ হয়ে বেঁচে থাকবে।
তুমি যে-বাংলাদেশ বানিয়ে দিয়ে গেছ তার বুনিয়াদের ওপর দ্রুত আমাদের কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব নেয়া পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সহজ হলো।
Advertisement
আবেদ, তোমার কাছে জাতি চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবে।”
গত শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) রাত ৮টা ২৮ মিনিটে ঢাকার অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফজলে হাসান আবেদ। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
স্যার আবেদ তার গড়া বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে চলতি বছর অব্যাহতি নেন। তাকে প্রতিষ্ঠানটির ইমেরিটাস চেয়ার নির্বাচিত করা হয়। দারিদ্র্য বিমোচন ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখায় স্যার আবেদ বাংলাদেশ ও বিশ্বের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অ্যাওয়ার্ড এবং সম্মাননা পেয়েছেন।
এইচএ/এমকেএইচ