বেশ ঘটা করে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশের চার দিনের মাথায় সে তালিকা স্থগিত করতে হয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে। নানা বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে তালিকা স্থগিত করা হলেও এ সময়ের ব্যবধানে সরকারকে নানা অবাঞ্ছিত সমালোচনায় পড়তে হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও বুকভরা কষ্টতো ছিলই। যে মুক্তিযোদ্ধা দেশের জন্য লড়াই করেছে নিজের সব সুখ-আহ্লাদ তুচ্ছ করে, তার নামটি যখন ৪৮ বছর পর স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের তালিকায় দেখা যায়, তখন রাষ্ট্র বা সরকারের প্রতি সে মুক্তিযোদ্ধার রাগ-ক্ষোভ জন্ম নেয়া অস্বাভাবিক নয়। বিতর্কিত এ রাজাকার তালিকা নিয়ে স্বরাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রীর বাহাস ছিল আরও বিস্ময়কর বিষয়। যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের কাম্য ছিল না।
Advertisement
কিন্তু এ ধরনের একটি ভয়ানক কর্মকাণ্ড কারা করল তার পূর্বপার তদন্ত করা খুব প্রয়োজনীয়। সরকার এখন এ বিষয়ে কী কঠোর পদক্ষেপ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়। এটা ভেবে খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই যে সরকারের ধারাবাহিকতার কারণে প্রশাসনচক্র পুরোপুরি সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আমলারা সবাই সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের এজেন্ডা পুরোপুরি বাস্তবায়নে আন্তরিক সেটাও ভাবার কোনো সুযোগ নেই। প্রায় ২৬ বছর এদেশ শাসন করেছে সামরিক স্বৈরাচারতন্ত্র ও স্বাধীনতাবিরোধীচক্র। এ সময়কালে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও স্বাধীনতাবিরোধীচক্রকে লালন করা হয়েছে বিভিন্ন কৌশলে। সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করা, খুনিদের আইনি সুরক্ষা দেয়া, স্বাধীনতাবিরোধীচক্র ও রাজাকারদের ক্ষমতাসীন করা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ঘোরাটোপে আবদ্ধ করার কাজটিসহ বহু অপকর্ম হয়েছে এ সময়ে। এসব অপকর্মের সঙ্গে জড়িত প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গ বা তাদের প্রেতাত্মারা এখনও সক্রিয় সেসব এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে।
এটা কে না জানে, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই একটি চক্র বঙ্গবন্ধুকে বিতর্কিত ও সমালোচিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিল। একপর্যায়ে তারা সফলও হয়েছিল। যার পরিণতি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নেয়া ও তার আস্থাভাজন অনেকেই ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর খুনি মোশতাকচক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। ১৯৭১ সালে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধাদের রোষানলে পড়ে নানা সংকট মোকাবিলা করতে হয়েছে অনেককে। সেই ব্যক্তিবর্গের অনেকেই আজ প্রভাবশালী। এই প্রভাবশালীচক্রের সতীর্থ এবং অনুসারী অনেকে আজ নানা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। সরকারের নানা অর্জনের মাঝে এরা কেউ আবার মুখোশের আড়ালে থেকে সংকট তৈরি করছে কি না তারও তদন্ত এ সময়ে খুব প্রয়োজন।
স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর রাজাকারের তালিকার মতো গুরুত্বপূর্ণ এবং সাহসী একটি কর্মযজ্ঞ এ ধরনের বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পড়া ঠিক হয়নি। এ তালিকা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের পর যে সমন্বয়হীনতার চিত্র ফুটে উঠেছে তা কখনোই বাঞ্ছনীয় নয়। সরকার দায়িত্ব নিয়ে একটি কাজ করার পর সে কাজটির জন্য ভুল স্বীকার কখনোই শক্তিশালী ও কার্যকর সরকারের জন্য শুভ নয়। এই অশুভ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য যারা দায়ী তাদের কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। যে আমলা বা প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের হাত ধরে এ তালিকা প্রকাশ হয়েছে তাদের আন্তরিকতা বা গাফিলতির বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে এখনই। নতুন করে তালিকা প্রকাশের আগেই পুরোনো তালিকার ত্রুটি-বিচ্যুতির সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এক্ষেত্রে যেন আগের মতো ভুল করা না হয়। এর আগেও আমরা দেখেছি, আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় বা প্রভাবশালী মহল থেকে অনেক অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন একাধিক ব্যক্তি। বিতর্কিত রাজাকার তালিকার নেপথ্যের কুশীলবদের রক্ষায় সে ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়া হলে জাতি ক্ষমা করবে না।
Advertisement
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ যখন উন্নয়নের মহাসড়কে এগিয়ে যাচ্ছে তখন কারা নানা সংকট তৈরি করে বা নেপথ্যে থেকে সংকট সৃষ্টিকারীদের সহযোগিতা করে বিতর্কের মুখে ফেরছে সরকারকে তার বিস্তারিত জাতির সামনে প্রকাশ হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে সরকার বা রাষ্ট্র চালাতে হলে, আইনের শাসন কায়েম করতে হলে আপন-পর ভাবার সুযোগ নেই। অপরাধের মূলোৎপাটন এবং অপরাধীর বিচার নিশ্চিত করাই হলো একটি শক্তিশালী ও কার্যকর সরকারের অন্যতম পরিচায়ক। তাই যারা রাজাকার তালিকাকে হাস্যস্পদ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তামাশা করেছে তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেয়া যাবে না। দেশের ইতিহাসের সূর্যসন্তানদের যারা কলুষিত করার চেষ্টা করেছে তাদের তালিকা তৈরি করে প্রকাশ্য বিচার চায় জনগণ।
লেখক : বিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক যায়যায়দিন ও সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ
Advertisement