ফিচার

কাঠের লঞ্চ থেকে বোরাক-রফরফের মালিক বারী খান

শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে শীর্ষে রয়েছেন তিনি। তিলে তিলে কীভাবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হয়; সেটাই যেন প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। একসময় চিংড়ি মাছের ব্যবসা ছিল, সেটা ছেড়ে দিয়ে নৌযান ব্যবসায় এলেন। বর্তমানে একজন সফল নৌযান ব্যবসায়ী তিনি। চাঁদপুর-ঢাকা রুটে নদী পথে চলাচল করে বোরাক, রফরফ লঞ্চ। এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম, তিনি চাঁদপুরের কৃতি সন্তান এম এ বারী খান। সফল এ ব্যবসায়ীর সফলতার গল্প বলেছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রিফাত কান্তি সেন—

Advertisement

ব্যবসা জীবনের শুরুর গল্প শুনতে চাই— এম এ বারী খান: ১৯৬৪ সালে এসএসসি পাস করি। আমাদের মূল ব্যবসা ছিল কাপড়ের। চাঁদপুর একটি নদী বন্দর। অধিকাংশ ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল পুরান বাজারে। সেখানে আমাদের কাপড়ের দোকান ছিল। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। যখন এসএসসি পাস করি; তখন আমার খুব ইচ্ছা ছিল পড়ালেখা করার। আব্বার ইচ্ছা ছিল না। তারা দুই ভাই ছিলেন। একজন মারা গেছেন। আব্বা বললেন, ‘বাবা, আমি তো লেখাপড়া জানি না, তুমি দোকানে বসো। কর্মচারীরা কী করে, না করে—আমি তো সব কিছু বুঝি না। তখন আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবসায়ে ঢুকলাম। এরপর আস্তে আস্তে ব্যবসায় অবনতি হতে লাগলো। পুরান বাজারের ব্যবসা ছেড়ে দিলাম।

কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে তাহলে কী করলেন?এম এ বারী খান: ১৯৬৮ সালে কাপড়ের ব্যবসা ছেড়ে চিংড়ি মাছের ব্যবসা ধরি। যে চিংড়ি মাছের ফ্যাক্টরি পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র তিনটি ছিল। শুরুতে চিংড়ি মাছের ব্যবসা বুঝে উঠতে পারিনি। আমার এক দুলাভাই চিংড়ি মাছের ব্যবসা করতেন। তার সাথেই চিংড়ি মাছের ব্যবসা করতে লাগলাম। ভালোই চলতে লাগলো। তখনই এলো অসহযোগ আন্দোলন। দেশ স্বাধীনের পর্ব। তখন আমি ব্যবসা ছেড়ে দেই। ১৯৬৯ সালে মতলবে বিয়ে করি। মতলবে প্রায় এক বছর আমার সম্বন্ধীর (স্ত্রীর ভাই) স্টেশনারি দোকানে ব্যবসা শুরু করি। ব্যবসায়ীর ছেলে বলে চাকরি করার কোন ইচ্ছা ছিল না। পরে আবার ফিরে গেলাম চাঁদপুর। সেখানে গিয়ে চিংড়ি মাছের ব্যবসা শুরু করলাম। ১৯৭৭ সালে প্রথম হজ করতে যাই। চিংড়ি ব্যবসায়ে একজন পার্টনার ছিলেন। আমি ছিলাম ছয় আনা, তিনি ছিলেন দশ আনা। আমাদের পরিবারের কেউ মাছের ব্যবসা করতো না। তাই তারা ফিফটি ফিফটি ব্যবসা দিতো না। আমি হজ করে আসার পর মনে হলো, এ ব্যবসা আমার জন্য ঠিক নয়। আমি একজন মুসলিম। আজ অথবা কাল চলে যেতে হবে। তখন আমি ভাবতে লাগলাম, কী ব্যবসা করা যায়। আমি নামাজ পড়ে বলতে লাগলাম, ‘আল্লাহ আমি কী ব্যবসা করে হক-হালালভাবে জীবন যাপন করতে পারবো?’

এরপরই কি লঞ্চ ব্যবসা শুরু করলেন?এম এ বারী খান: হ্যাঁ, অনেক চিন্তা-ভাবনার পর স্থির করলাম—যদি আমি লঞ্চ ব্যবসা করি, এরমধ্যে সরকারিভাবে নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা আছে। মিথ্যা কথা বলার কিছু নেই। সরকারের নির্ধারিত ভাড়া অনুযায়ীই ভাড়া নেবো। তারপর আরেকটি চিন্তা হলো, কত গরিব-মিসকিনের টাকা-পয়সা নেই। ভাড়ার জন্য বাড়ি যেতে পারছেন না। কারো মানি ব্যাগ ছিনতাই হয়। সে কীভাবে বাড়ি যাবে? তখন স্টাফদের বলে দিলাম, ‘কোন লোক যদি বিপদে পড়ে। তবে তাকে ছাড় দিবা এবং তাকে বাড়ি যাওয়ার পয়সাও দিয়ে দিবা।’

Advertisement

সেই লঞ্চ ব্যবসার প্রথম দিকটা কেমন ছিল?এম এ বারী খান: আমি নিজের পয়সা খরচ করে ইচলীতে ঘাট বানাই সরকারকে রাজস্ব দিয়ে। আমার কাঠ বডির একটি লঞ্চ ছিল ঝিলু। স্টিল বডির লঞ্চ ছিল ঝিলু-২। সেখান থেকে আমার শুরু। আমি আবার যখন স্ত্রীসহ হজে গেলাম; তখন শুনলাম আমার রুটে লঞ্চ দিয়ে দিয়েছে। তখন সেখান থেকে আল্লাহর কাছে চাইলাম, আল্লাহ যদি আমাকে ফিরিয়ে নেয়, যদি লঞ্চ বানাতেই হয়—তবে তার নাম দেবো ‘ঝমঝম’। এসেই নতুন একটি লঞ্চের প্রত্যায়ন নিলাম। নাম দিলাম ‘আবে ঝমঝম’। এরপর ঝিলু বাদ দিলাম। এখন চিন্তা হলো দ্রুত একটি লঞ্চ বানিয়ে কী নাম দিতে পারি? তখন ‘আল বোরাক’ নাম দিলাম। যেহেতু আমাদের নবী করিম (স.) মেরাজ শরীফে গিয়েছিলেন বোরাক নামের দ্রুতগতির বাহন দিয়ে। এরপর ভাবলাম, এর চেয়ে দ্রুত আর কী বানানো যায়। তখন নাম দিলাম ‘রফরফ’। মোটামুটি আমার নামগুলো ইসলামিকভাবেই দেওয়া। চাঁদপুর রুটে যখন আমি নৌযান ব্যবসায় নামি; তখন নদীতে বড় বড় লঞ্চ চলতো। কাঠ বডি এবং স্টিল বডি, তবে সেগুলো হারিকেন দিয়ে চলতো। আমিই একমাত্র ব্যক্তি, যে প্রথম কাঠ বডিতে টু টোয়েন্টি জেনারেটর লাগিয়েছি এবং পানিতে টিউবলাইট আমিই প্রথম ভাসিয়েছি।

বর্তমানে আপনি কী কী ব্যবসায়ের সাথে জড়িত আছেন?এম এ বারী খান: বর্তমানে আমি লঞ্চ ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। পাশাপাশি নিউমার্কেটে আমার একটি দোকান আছে। সেটা ফাস্ট ফুডের দোকান। সেগুলো ভাড়া দেওয়া। এছাড়া বসুন্ধরায় দু’টি দোকান আছে, সেগুলোও ভাড়া দিয়ে রেখেছি।

যারা নতুন করে ব্যবসায়ে আসতে চাচ্ছেন, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?এম এ বারী খান: তাদের জন্য বলার হচ্ছে, ব্যবসা একটি পবিত্র জিনিস। তাদের উদার মানসিকতা থাকতে হবে। আল্লাহর ওপর বিশ্বাস থাকতে হবে। ব্যবসায়ের মূলধন হলো জবান। যেমন- আমি আপনার কাছ থেকে এক মাসের কথা বলে টাকা নিলাম, আমার অবশ্যই সময়মত টাকাটি ফেরৎ দিতে হবে।

এখনকার ব্যবসা আর আগের ব্যবসার মাঝে কি কোন পার্থক্য আছে?এম এ বারী খান: তফাৎ যার যার কাছে। এখনকার প্রজন্মের সাথে তখনকার ব্যবসা খাপ খাবে না। আমি এসব বলতেও চাই না।

Advertisement

শূন্য থেকে শীর্ষে পৌঁছালেন, বিষয়টি আপনি কি সহজ মনে করেন?এম এ বারী খান: না, অত সহজ না। ব্যবসা করতে হলে ব্যবসায়ীর এক নম্বর চালান হলো মূলধন। দুই নম্বর হলো জবান ঠিক রাখতে হবে। পয়সা রোজগার করতে হলে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। আমি যে লঞ্চের ব্যবসা শুরু করেছি। সেখানে রাত-দিন খেটেছি।

একজন সফল ব্যবসায়ী হতে গেলে কী ধরনের মূলমন্ত্র থাকা চাই?এম এ বারী খান: এক নম্বর হলো সৎ হতে হবে। দ্বিতীয়ত জবান ঠিক রাখতে হবে।

নৌযান ব্যবসা এখন কতটা লাভজনক?এম এ বারী খান: নৌযান ব্যবসাটি লাভজনক ছিল। কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থাটি নেই।

এ মুহূর্তে আপনার কয়টি লঞ্চ নদীতে চলছে?এম এ বারী খান: এ মুহূর্তে চারটি বড় লঞ্চ নদীতে চলছে। আল বোরাক, আল রফরফ, রফরফ-২, রফরফ-৭।

প্রতিযোগিতার বাজারে আপনার লঞ্চ টিকিয়ে রাখার জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছেন?এম এ বারী খান: আসলে বিষয়টি নিয়ে আমি তেমন কিছু বলতে চাই না। তবে আধুনিকতার কোন ঘাটতি রাখিনি। লঞ্চগুলোকে আধুনিক মানের হিসাবে তৈরি করেছি। মানুষ এগুলোতে উঠে বেশ কমফোর্ট ফিল করে। আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য যা যা করা দরকার, সব কিছুই করেছি।

ব্যবসায়ে লোকসান হওয়ার পর কী মনে হয়েছে, যে ব্যবসা আর করবো না?এম এ বারী খান: না, এসব আমার কখনোই মনে হয়নি। ব্যবসায়ে লাভ-ক্ষতি থাকবেই। সেটিকে মেনে নিতে হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এবার সন্তানদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চাই। তাদের বলেছি, তোমরা ব্যবসা বুঝে নাও।

ব্যবসা এবং চাকরির মাঝে আপনি কী ধরনের পার্থক্য খুঁজে পান?এম এ বারী খান: ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবী—তাদের মন এক হয় না। কারণ যিনি ব্যবসায়ী তার কিন্তু মনে হয় না যে, আমি আজ কত টাকার বাজার করবো। কিন্তু যিনি চাকরিজীবী তাকে অনেক কিছু চিন্তা করতে হয়। কারণ সীমিত বেতনের মাঝেই তাকে নিজের চাহিদা, পরিবারের চাহিদা মেটাতে হয়। সুতরাং চাকরি এবং ব্যবসায়ের মাঝে ব্যাপক ফারাক।

ভবিষতে আর কোনো নৌযান নামানোর ইচ্ছা আছে?এম এ বারী খান: না। প্রায় ৪০ বছর তো ছিলাম এ ব্যবসায়। আর লঞ্চ নামাতে চাই না। হয়তো ছেলেরা নামাতে পারে।

জাগো নিউজের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ। এম এ বারী খান: আপনাকে ও জাগো নিউজকে ধন্যবাদ।

এসইউ/এমএস