দেশজুড়ে

বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতিমন্ত্রীর নাম রাজাকারের তালিকায়

বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে শহীদ হওয়ার খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। এ ঘটনায় সর্বপ্রথম প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন তৎকালীন মহকুমা বরগুনায়।

Advertisement

সেই সময় বরগুনার বেতাগী অঞ্চলের এমপি ও বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিপরিষদের শিল্প প্রতিমন্ত্রী ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাদা মালেক খান। খন্দকার মোশতাক ছিলেন মালেক খানের বড় ভায়রা। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শাহজাদা মালেক খানকে মন্ত্রিপরিষদে যোগদানের জন্য অনুরোধ জানান খন্দকার মোশতাক। তখন শাহজাদা মালেক খান বলেছিলেন, ‘ভাইজান, আমার জীবন থাকতে বঙ্গবন্ধুর রক্তের ওপর পা রেখে মন্ত্রিসভায় যাব না।’

কিন্তু অবাক করা বিষয় মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধু সরকারের শিল্প প্রতিমন্ত্রী শাহজাদা মালেক খানের নাম এসেছে সদস্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায়। এতে ক্ষুব্ধ বরগুনার রাজনৈতিক নেতাসহ সাধারণ মানুষ। ক্ষুব্ধ তার পরিবারের সদস্যরাও।

স্থানীয় প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শাহজাদা মালেক খান বঙ্গবন্ধু সরকারের শিল্প প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গঠিত মন্ত্রিসভার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। সেই সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন বৃহত্তর পটুয়াখালী জেলার বাকশালের গভর্নর হিসেবেও।

Advertisement

শাহজাদা মালেক খান ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে পাথরঘাটা-বরগুনা আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে অসহযোগ আন্দোলনে বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে বেতাগী, বামনা, পাথরঘাটা ও কাঁঠালিয়া থানার নেতৃত্ব দেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর মুজিব নগরের অস্থায়ী সরকারের অধীনে স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

সদ্য প্রকাশিত রাজাকারের তালিকায় দেখা যায়, তালিকায় প্রকাশিত ২১ নম্বর পৃষ্ঠায় ১৯৭২ সালের ১৯ জুলাই দায়েরকৃত মামলায় তার নাম আছে ৭৫ নম্বরে। মামলা নম্বর-৪৪। মালেক খানের বাড়ি বরগুনার বেতাগী উপজেলার কাউনিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম আলী আবদুল্লাহ খান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বরগুনা মহকুমার এসডিওর দায়িত্ব পালন করেছিলের সিরাজ উদ্দীন আহমেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর প্রতি অবিচল ভালোবাসা, সততা আর ক্ষমতার প্রতি নির্লোভের অনন্য উদাহরণ মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী শাহজাদা মালেক খান। অথচ তার নাম এখন রাজাকারের তালিকায়। এটা কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। এর থেকে দুঃখজনক ঘটনা আর কিছু হতে পারে না।

বরগুনা মহকুমার সাবেক এসডিও সিরাজ উদ্দীন আহমেদ আরও বলেন, বর্তমান বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল মোতালেব মৃধা রেডিওতে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনে আমার কাছে ছুটে আসেন। খবরের সত্যতা জানতে বরগুনার তৎকালীন এমপি শাহজাদা মালেক খান, আসমত আলী সিকদার ও নিজাম উদ্দিনের সঙ্গে যোগযোগ করি আমি। পরে বিষয়টি নিশ্চিত করেন তারা।

Advertisement

মুক্তিযোদ্ধা শাহজাদা মালেক খান

এরপর তাদের সমর্থন নিয়ে বরগুনার তৎকালীন মহকুমা পুলিশ অফিসার (এসডিপিও) ফারুক আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশ লাইন যাই। সেখানে সব পুলিশ সদস্যের উদ্দেশ্যে বলেছি, এই সরকার অবৈধ। এই সরকার মানি না। এ সময় মহকুমার সর্বত্র জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার নির্দেশ দেই।

এরপর তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জাহাঙ্গীর কবীর ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোতালেব মৃধাকে নিয়ে বরগুনার ওয়াপদা অফিসে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে যাই। তখন রক্ষীবাহিনীর সেক্রেটারি ছিলেন আব্দুল লতিফ মাস্টার। জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন নুরুল ইসলাম সিকদার। তাদের সঙ্গে আলাপ করে সবাইকে সংগঠিত হতে বলি।

সিরাজ উদ্দীন আহমেদ আরও বলেন, ১৬ আগস্ট আমার বাংলোয় (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের বাংলো) আয়োজন করা হয় বঙ্গবন্ধুর শোকসভার। শোকসভায় বরগুনার বিভিন্ন পদে কর্মরত সরকারি কর্মকর্তা, ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতাসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেয়। এর মধ্য দিয়ে অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়। এরপর শুরু হয় আন্দোলন। আর এই আন্দোলন ছিল পুরো দেশের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম প্রতিবাদ। এটি নেতৃত্ব দিয়েছেন শাহজাদা মালেক খান।

শাহজাদা মালেক খানের ছেলে মন্টি খান বলেন, আমার বাবার নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় বিস্মিত। এর প্রতিবাদ জানিয়ে বিষয়টি সুরাহার জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর কবির বলেন, যার নেতৃত্বে আমরা বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার প্রথম প্রতিবাদ করেছি। যার কাছ থেকে আমরা রাজনৈতিক দীক্ষা নিয়েছি। যিনি বঙ্গবন্ধুর ও তার পরিবারের জন্য বহু ত্যাগ স্বীকার করেছেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরও তার নাম এখন রাজাকারের তালিকায়। এটা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। আশাকরি খুব দ্রুত এ তালিকা সংশোধন হবে।

এরই মধ্যে নানা বিতর্কের মুখে তিনদিনের মাথায় বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজাকারের তালিকা স্থগিত করেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে আগামী ২৬ মার্চ রাজাকারের নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়।

মো. সাইফুল ইসলাম মিরাজ/এএম/জেআইএম