জাতীয়

যেভাবে হত্যা করা হয় চীনা নাগরিক গাউজিয়ান হুইকে

ঢাকার বনানীতে চীনের নাগরিক গাউজিয়ান হুই (৪৩)-কে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়ার ঘটনায় দুইজনকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তারা হলেন- আব্দুর রউফ (২৬) ও এনামুল হক (২৭)। মঙ্গলবার তাদের গ্রেফতার করা হলেও বুধবার এক বার্তায় বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

Advertisement

পরে বুধবার দুপুরে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হত্যার বর্ণনা ও কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) মো. আবদুল বাতেন।

গ্রেফতার দুইজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে তিনি জানান, গ্রেফতার দুইজন বনানীর ২৩ নম্বর রোডের ৮২ নম্বর বাসার সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে কর্মরত ছিল। তারা ওই বিল্ডিংয়ের ছাদে বসবাস করত। একসাথে চাকরির সুবাদে তারা বন্ধুও ছিল। তবে তারা ভবনে বসবাসকারী বিত্তবান লোকদের জীবনযাত্রার বিপরীতে নিজেদের দৈন্যদশায় হতাশাগ্রস্ত হয় এবং নিজেদের ভাগ্য কিভাবে পরিবর্তন করা যায় তা নিয়ে নিজের মধ্যে আলোচনা করেন।

এক পর্যায়ে হত্যাকাণ্ডের বেশ কয়েকদিন আগে রউফ ইনামুলকে প্রস্তাব দেয় যে, চীনা নাগরিক হুই অনেক বড় ব্যবসায়ী, অনেক টাকা-পয়সা নিয়ে আসা-যাওয়া করে এবং ফ্ল্যাটে একা থাকে। তাকে শেষ করে দিয়ে যা নিতে পারব তা দিয়ে জীবনে কিছু করা যাবে।

Advertisement

পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা সুযোগ খুঁজতে থাকে। এদিকে তারা নিশ্চিত হয় যে, বিল্ডিংয়ে সিসিটিভি ক্যামেরাতে ভিডিও রেকর্ড হয় না। কারণ হার্ডডিস্ক ছিল না। প্রথমে ৬ ডিসেম্বর তারা হুইকে হত্যার চেষ্টা করে। ওই দিন তারা সন্ধ্যায় চীনা নাগরিক গাউজিয়ান হুই-এর ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাটে কলিং বেল দেয়। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ দরজা না খোলায় ভয়ে তারা আবার ফিরে আসে।

আব্দুল বাতেন বলেন, প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ১০ ডিসেম্বর তারা আবার পরিকল্পনা করে যে, আজকে ‘কাজ শেষ করতেই হবে’। পরিকল্পনা অনুযায়ী ইনামুল তার নিজের ব্যবহৃত গামছা সাথে নিয়ে যায়। মাগরিবের আযানের পরপরই তারা হুই-এর ফ্ল্যাটের সামনে যায় এবং রউফ কলিং বেল দেয়।

গাউজিয়ান হুই দরজা খুলে ওদের দিকে বিস্ময়ে তাকান। তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষা জানতেন না। তবে ইশারায় জানতে চাচ্ছিলেন যে, কী বিষয়? তখন ইনামুল বলে, ‘ওয়াটার, ওয়াটার’। মানে বুঝাতে চায় যে, তারা পানি খাবে। মুহূর্তের মধ্যেই তারা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে এবং ইনামুল গলায় গামছা পেঁচিয়ে ধরে আর রউফ কোমরের দিকে জাপটে ধরে। অল্প সময়ের মধ্যেই হুই-এর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে হুই রউফের বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে কামড় দেয়। তারা ২/৩ মিনিটের মধ্যেই হুই-এর মৃত্যু নিশ্চিত করে।

ফ্ল্যাটের ভেতরে ড্রয়িং রুমের টেবিলের ওপরে হুই-এর ল্যাপটপ খোলাই ছিল এবং তার পাশে সার্বক্ষণিক সাথে থাকা ছোট ব্যাগ ছিল। রউফ ওই ব্যাগ খুলে ৩টি ১ হাজার টাকার বান্ডিল, কিছু খুচরা টাকা ও মোবাইল লুট করে। এরপর হুই-এর মরদেহ ড্রয়িং রুমে নিয়ে গামছা দিয়ে রক্ত মুছে তারা ছাদে চলে যায়। ছাদে গিয়ে গামছা ধুয়ে ফেলে ও নিজেরা গোসল করে দু’জনে একসাথে বের হয়ে যায়।

Advertisement

হত্যার পর দুইজন টাকাগুলো ভাগ করে নেয়। রউফ নেয় ১ লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং এনামুলকে দেয় ১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। পরে তারা বনানী সুপার মার্কেটের পাশে একটি চায়ের দোকানে বসে চা খায় এবং টাকাগুলো কী করবে তা নিয়ে আলোচনা করে।

আব্দুল বাতেন আরও বলেন, তদন্তে দেখা যায়- রউফ সুপার মার্কেটের আশেপাশে থাকা তিনটি বিকাশের দোকান থেকে গ্রামের বাড়িতে বন্ধু হাসানের কাছে ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা পাঠায়। ইনামুল চারটি বিকাশের দোকান থেকে তার নিজের বিকাশে ৫০ হাজার টাকা, এলাকার বড় ভাই করিমের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা, বন্ধু শাহীনের কাছে ৪০ হাজার এবং তার মেজো ভাবীর কাছে ৩০ হাজার টাকাসহ মোট ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা পাঠায়।

এর আগে হত্যার দিন সকাল সাড়ে ১০টায় রউফ সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে ডিউটি করে। বেলা ১১টায় রউফ বিল্ডিংয়ের পেছনের দিকে বালু মাটিতে কাঠের টুকরো দিয়ে গর্ত করে ওপরে যায়। অপর একজন সিকিউরিটি গার্ডের সহায়তায় লিফট ব্যবহার করে ভিকটিমের লাশ মাটিচাপা দেয়। পরের দিন হুই-এর ড্রাইভার, কাজের বুয়া তাকে তার বাসায় না পেয়ে এবং তার ব্যবহৃত সেন্ডেলে রক্তের দাগ দেখে খোঁজাখুঁজি শুরু করে। এক পর্যায়ে হুই-এর ড্রাইভার সুলতান বিল্ডিংয়ের পেছনে মাটিচাঁপা অবস্থায় পায়ের গোড়ালি দেখে এবং পরে সংবাদ পেয়ে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে।

গ্রেফতার দুইজনের কাছ থেকে হুই-এর ব্যবহৃত ১টি ভাঙা মোবাইল ফোন, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত গামছা, বালতি ও লাশ মাটিচাপা দেয়ার জন্য গর্ত খোঁড়ার কাজে ব্যবহৃত কাঠের টুকরা এবং ১ লাখ ২১ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

এদিকে বেলা সাড়ে ১১টায় ব্রিফিং হওয়ার আগে ২০-২৫ জন চীনা নাগরিক মিডিয়া সেন্টারে উপস্থিত হন। তাদের মধ্যে নিহত হুই-এর আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও তার স্ত্রী লিউ হুই ও দুই ছেলে-মেয়ে উপস্থিত ছিলেন।

ডিবি গণমাধ্যমের সামনে হত্যার বর্ণনা দিতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন স্ত্রী লিউ হুই। ব্রিফিং চলাকালে তার ছেলে এবং মেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে ছিলেন। ব্রিফিং শেষে যখন মাটি চাপা থেকে উদ্ধারের ফুটেজ দেখানো হয় তখন তার পুরো পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

চীনা নাগরিক গাউজিয়ান হুই একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। ওই ফ্ল্যাটে দীর্ঘ ১ বছর যাবৎ বসবাস করে আসছিলেন। চীন থেকে পাথর ও নির্মাণ সামগ্রী আমদানি করে পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্দরে সাপ্লাই করতেন তিনি।

এআর/আরএস/পিআর