আইন-আদালত

সুপ্রিম কোর্ট দিবস : বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কিছু অজানা ইতিহাস

বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধন করেন। সে কারণে প্রতি বছর ১৮ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে প্রথম যেদিন উচ্চ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল (১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর), সেদিন অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালন করা হবে বলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞার সভাপতিত্বে সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়।

Advertisement

যখন সুপ্রিম কোর্ট দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় তখন নিয়মিত কোন প্রধান বিচারপতি ছিলেন না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে কোনো গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য অতীব জরুরি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সদ্যস্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে পায় নতুন সংবিধান।

সেই সংবিধানে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী এবং জনগণের আশা-আকাঙ্খা ও চাহিদার প্রতিফলন। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধন করেন। যা তার রাজনৈতিক দূরদর্শী চিন্তা ও চেতনার ফসল বলে সহজেই অনুমেয়।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্ন বিভিন্ন সময়ে তার রাজনৈতিক সভার ভাষণে প্রত্যক্ষ করা যায়। ১৯৭২ সালে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথককরণের (Separation of Power) উদ্যোগ নেন। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি দৈনিক বাংলা পত্রিকার ষষ্ঠ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতার অংশবিশেষ এখানে উদ্ধৃত করা যাক।

Advertisement

বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘আমি হাইকোর্ট ও অধস্তন আদালতগুলো যাতে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করব। আমি এ ব্যাপারে সুনিশ্চিত করতে চাই যে, দুর্নীতি ও কালক্ষেপণ উচ্ছেদ করার প্রেক্ষিতে বিচার ব্যবস্থার কতকগুলো মৌলিক ত্রুটি সংশোধনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের নীতি সূক্ষ্মভাবে পর্যলোচনা করা হবে।’

বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, উইকিপিডিয়িায় ও বিশ্বকোষ এবং বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইট-এর প্রাপ্ত তথ্য থেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো।

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট (Bangladesh Supreme Court) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত। বাংলাদেশের সংবিধানের ষষ্ঠ অধ্যায়ে সুপ্রীম কোর্ট প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আইনী বিধান রয়েছে। সংবিধানের ধারা ১০০-এর বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের রমনায় সুপ্রীম কোর্ট অবস্থিত। এটা সচরাচর হাইকোর্ট নামে সমধিক পরিচিত; কারণ ১৯৭১ সালের পূর্বে এই ভবনে পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ আদালতের কার্যক্রম পরিচালিত হতো।

বাংলাদেশের সংবিধানের ষষ্ঠ অধ্যায়ের ৯৪ ধারায় সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আইনী বিধান ব্যাক্ত করা হয়েছে। এই ধারার (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট’ নামে বাংলাদেশের একটি সর্বোচ্চ আদালত থাকিবে এবং আপিল বিভাগ (Appellate Division) ও হাইকোর্ট বিভাগ (High Court Division) লইয়া তাহা গঠিত হইবে।

Advertisement

এই ধারার (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘প্রধান বিচারপতি এবং প্রত্যেক বিভাগে আসন গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপতি যেরূপ সংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন বোধ করিবেন, সেইরূপ সংখ্যক অন্যান্য বিচারক লইয়া সুপ্রিম কোর্ট গঠিত হইবে।’ আরো বলা হয়েছে যে, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ‘বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি’ নামে অভিহিত হইবেন।

পরবর্তী অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগে নিযুক্ত বিচারকগণ কেবল উক্ত বিভাগে এবং অন্যান্য বিচারক কেবল হাইকোর্ট বিভাগে আসন গ্রহণ করিবেন।’ এবং চতুর্থ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘সংবিধানের বিধানাবলী সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারক বিচারকার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’

সংবিধানের ধারা-১০০ এর বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে সুপ্রিম কোর্টের স্থায়ী আসন অবস্থিত হবে। তবে বিধান আছে যে, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনক্রমে প্রধান বিচারপতি সময়ে সময়ে অন্য যে স্থান বা স্থানসমূহ নির্ধারণ করবেন, সেই স্থান বা স্থানসমূহে হাইকোর্ট বিভাগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে পারবে।

সুপ্রিম কোর্টে এবার দ্বিতীয়বারের মতো ‘সুপ্রিম কোর্ট দিবস’ পালন করতে যাচ্ছে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট-এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং বঙ্গবন্ধুর বিচার বিভাগ নিয়ে সুদূরপ্রসারী ভাবনা নিয়ে পেছন ফিরে দেখার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। আর তাতে আমরা এমন কিছু দেখি, যা আমাদের যেমন আশাবাদী করে তেমনি কিছু বিষয়ে মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ১৯৬৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর বর্তমান সুপ্রিম কোর্ট ভবন উদ্বোধন করেছিলেন আইয়ুব খান। যদিও এই ভবন নির্মাণের সার্বিক তদারকিতে ছিলেন গভর্নর মোনায়েম খান। প্রধান বিচারপতি ছিলেন টিক্কা খানকে শপথ না দেওয়ার জন্য বিখ্যাত বদরুদ্দীন আহমেদ সিদ্দিকী।

দেশ ও জাতিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সরকারের তিনটি অঙ্গ- শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হয়। পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্র তা-ই করে। অন্যান্য বিভাগের ওপর শাসন বিভাগের আধিপত্য, যা ব্রিটিশ আমল থেকে দৃশ্যমান, সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই কাম্য নয়। দীর্ঘদিনের স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে নয়, বরং স্বাধীন বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্র তৈরি করার মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা ভেবেছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা সাবেক প্রধান বিচারপতি আমিন আহমেদ এবং জনাব এমএ ইস্পাহানি তাদের লেখা হতে কিছু বিষয় উপলব্ধিতে আসে। কেননা তারা দুজনেই সততা ও শুদ্ধতার জন্য সুনামের জন্য সুখ্যাত ছিলেন। প্রধান বিচারপতিগণ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যারাই অবসরে যান তারা অনেকটা নিরবতা পালন ও মানুষের অন্তরালে গিয়ে অবসর জীবন কাটিয়ে দেয়াকে নিরাপদ মনে করেন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি আমিন আহমেদ এভাবে তার মন্তব্য লিখেছেন, ‘সরকারে যে যখনই থেকেছে, তার বাছ-বিচার না করে পাকিস্তানের বিচার বিভাগ সর্বদা আইনের শাসনের শ্রেষ্ঠত্বের ঝান্ডা তুলে ধরেছে।’ তিনি আরো লেখেন, ‘বিচার বিভাগের প্রতি দেশের মানুষের অগাধ আস্থা, আল্লাহকে ধন্যবাদ, তিনি নির্বাহী বিভাগের তরফে বিচার বিভাগের ওপর এমন কোনো বিপদ আসতে দেননি, যেমনটি গোলামির জিঞ্জির ভেঙে বেরিয়ে আসা অন্য কতিপয় দেশ প্রত্যক্ষ করেছে।’

১৯৫৪ সালে প্রধান বিচারপতি হওয়া আমিন আহমেদ ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনকালেও প্রধান বিচারপতি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ওই সময় প্রতিটি আইয়ুব সরকারের সেনা প্রশাসকেরা হঠাৎ ‘জনস্বার্থে’ আদেশ জারি করেছিলেন যে, অধস্তন আদালতের বিচারাধীন মামলা এক সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে।

তখন আমিন আহমেদ তৎকালীন জিওসিকে ফোন করে বলেছিলেন, এই আদেশ বহাল থাকার অর্থ হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অপমৃত্যু। জিওসি দ্রুত ওই আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। আমিন আহমেদের আরেকটি উক্তি মনে রাখার মতো। যেমন তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের শাসনকার্যে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত এসেছে। কিন্তু কখনো বিচার বিভাগের কর্তৃত্বের ওপর আঘাত কেউ হানেনি। এমনকি সামরিক শাসনের যৌবনকাল যখন তেজদীপ্ত, তখনো বিচার বিভাগীয় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়নি।’

অপর সাবেক প্রধান বিচারপতি হলেন এমএ ইস্পাহানি। সাতচল্লিশের দেশভাগের যে সময়টায় কলকাতা হাইকোর্ট থেকে কিছু চেয়ার-টেবিল, ঘড়ি ইত্যাদি ভাগের-ভাগ হিসাবে আমরা পেয়েছিলাম, তখন পূর্ববঙ্গ সরকারের আইন ও বিচার সচিব ছিলেন ইস্পাহানি।

তিনি তার লেখায় উল্লেখ করেন, ‘বিচারকেরা তখন বারান্দায়ও বসতেন। বিলাতি বিচারক ওয়েন-পেরি এসব দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, আপনারা যে অবস্থায় বিচারকার্য করছেন, তার প্রশংসা না করে কারও উপায় নেই।’ তিনি স্মরণ করেন, এক শনিবারের সকালে মোনায়েম খান নতুন ভবনের স্থান নির্ধারণ করেছিলেন। (তথ্যসূত্র: প্রথম আলো পত্রিকা)

বর্তমান সুপ্রিম কোর্ট ভবনের উত্তর-পূর্বাংশে সাতচল্লিশে সামরিক বাহিনীর ব্যারাক ছিল। আইয়ুব খান তখন ঢাকার জিওসি ছিলেন। গুণমানসম্পন্ন আমাদের মূল সুপ্রিম কোর্ট ভবন কতটা কম সময়ে ও খরচে নির্মিত হয়েছিল, তার সঙ্গে পরবর্তীকালের নির্মাণ ব্যয় ও মানের একটা তুলনা দাবি করা কম কৌতুকপ্রদ হবে না।

১৯৬৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। আর চৌকস প্রকৌশলীদের একটি দল ৪৩০ ফুট দৈর্ঘ্যের ও ৩৭০ ফুট প্রস্থের ১৯টি বিচারকক্ষ- সংবলিত ভবনটি মাত্র ৭৪ লাখ ৭৫ হাজার রুপিতে নির্মাণ করে।

মূল প্রাক্কলিত খরচের মধ্যেই ২ লাখ ২৩ হাজার ৬০৭ বর্গফুটের ইমারত নির্মাণ করা সম্ভব হয়। মেসার্স চিশতি ব্রাদার্সের ডিজাইনে গড়া ইমারতটির প্রতি বর্গফুটে ৩৩ রুপি খরচ পড়ে। বিচারপতি এমএ ইস্পাহানি তার মন্তব্যে লিখেছিলেন, ‘গাঢ় সবুজের মধ্যে গম্বুজটি যেন একটি মুক্তা হয়ে বসেছে। আশা করব এখান থেকে বিচারপ্রার্থীরা ন্যায়বিচার পাবেন। ইনশাআল্লাহ, এই আদালতের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিখ্যাত হবে। অন্যান্য হাইকোর্ট তাকে ঈর্ষা করবেন।’

গবেষণা ও পড়াশোনার নানাদিক বিচার বিশ্লেষণে বিশ্বে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়ার্ল্ড র্যাংকিং হয়। বাংলাদেশের সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং সকলেই জানি; কিন্তু মানসম্মত সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম বিচারের নিরিখে এমন কোনো র্যাংকিং হয় কিনা জানি না। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের কোনো রায় দেশের বাইরের কোনো উচ্চ আদালতের রায়ে উদ্ধৃত হয়েছে কি না, জানা নেই।

তবে ১৯৬৩ সালে আবদুল হক বনাম ফজলুল কাদের চৌধুরী মামলায় (মিনিস্টার কেস নামে পরিচিত) ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মোর্শেদের রায়ে প্রথমবারের মতো সংবিধানের মৌলিক কাঠামো চূড়ান্ত হয়। যা সুপ্রিম কোর্টে উদ্ধৃত করা হয়, যেটি উল্লেখ হয়েছে PLD 1963 SC 486 নং পৃষ্ঠায়।

১৯৬৫ সালেই সজ্জন সিংয়ের মামলায় (AIR 1967 (SC) 1643) ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তা গ্রহণ করেছেন। দিল্লিতে ভারতের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল সোলি সোরবজির বাসভবনে গিয়ে তার মুখেও এ কথা শুনেছি। সোরবজি ড. কামাল হোসেনকে বলেছেন, ‘আপনারা এই রায়টির জন্য বিশেষ গর্ব করতে পারেন।’

আসলে রাষ্ট্রের অন্য বহু সংস্থা যেভাবে রেওয়াজ ও ঐতিহ্য ছাড়া চলতে পারে, সেভাবে সুপ্রিম কোর্ট পারেন না। ভালোভাবে এক কদমও না। তাই অকারণে জ্যেষ্ঠতার নীতি না মানা, আপিল বিভাগ ও হাইকোর্টের বিচারকসংখ্যা নির্দিষ্ট না করা, আবার নির্দিষ্ট করেও তা মান্য না করা, নানা কৌশলে বিচারকদের ওপর নির্বাহী বিভাগীয় আধিপত্য ধরে রাখা, নিয়োগপ্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা বজায় রাখতে আইন না করার মতো বিগত বাংলাদেশি সরকারগুলোর অভিন্ন বৈশিষ্ট্যগুলো অবশ্যই জনমনে নানা প্রশ্নের উদ্রেক করে।

আশার কথা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও পৃথককরণ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বর্তমান সরকার নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। তবে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতাকেন্দ্রিক আধিপত্য কমে যেতে পারে- এ আশঙ্কায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে কিছুটা গড়িমসিও দেখা যায়।

যা-ই হোক, বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা এবং বর্তমান সরকার ও তার আইনমন্ত্রী সংবিধান অনুযায়ী বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কনসেপ্টটিতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর- এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আপাতদৃষ্টিতে শেখ হাসিনা সরকার সেটি করছে বলে মনে হয়।

বর্তমান যে সুপ্রিম কোর্টের অবয়ব দেখি তার আদি পর্বের (১৭৭৪) সূচনা কলকাতার মাটিতে। সেই অর্থে স্যার এলিজা ইম্পে আমাদেরও প্রথম প্রধান বিচারপতি ছিলেন। তার নেতৃত্বাধীন আদালতে মহারাজা নন্দ কুমারের সবচেয়ে বিতর্কিত বিচারটি হয়েছিল।

হেস্টিংসের আনা কথিত জালিয়াতি মামলার শুনানি ১৭৭৫ সালের ৮ জুন শুরু হয়ে ১৫ জুন প্রায় মধ্যরাতে শেষ হয়। ভোররাত চারটায় প্রধান বিচারপতি ইম্পে নন্দ কুমারের ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। বিখ্যাত আইনবিদ ম্যাকুলে এবং কিছু ঐতিহাসিকের মতে, এটা ছিল বিচারিক হত্যাকাণ্ড।

সরকার প্রধান (গভর্নর জেনারেল) ছিলেন ইম্পের স্কুলসহপাঠী বিতর্কিত ওয়ারেন হেস্টিংস। এটি তার ইচ্ছা পূরণের রায় ছিল বলে অভিযোগ আছে। রাষ্ট্রের বা রাজনৈতিক স্বার্থের সঙ্গে সংঘাতে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা খর্ব হওয়াটাই কিন্তু ইতিহাস। বিচারক অপসারণে জনপ্রতিনিধিদের শ্রেষ্ঠত্বের বাণী ইদানিং শোনা যায় যদিও তা বেশিদিন ধোপে টেকেনি।

সে সময় লোকে বলতো আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্রিকেট ও জুডিসিয়ারি নিয়ে গর্ব করতেন। আমরাও এখন আমাদের ক্রিকেট ও জুডিসিয়ারি নিয়ে গর্ব করতে পারি। যদি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়, তবে গণতন্ত্র ও উন্নয়ন শক্তিশালী ভিত্তির ওপর সু-প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

সেদিক বিবেচনায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আমাদের রাষ্ট্রের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক (Separation of Power) হওয়াটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার সবচেয়ে শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম মাত্র।

পরিশেষে ভারতীয় বিচারপতি কৃষ্ণা আয়ারের উক্তিটি যুক্তিগ্রাহ্য, ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ ছাড়া গণতন্ত্র দাসত্বে পরিণত হতে পারে’। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট শান্তি ও উন্নয়নের জন্য ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরলস কাজ করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।

Email : tajul_jdjbd71@yahoo.com

আইএইচএস/এমএস