৪৪ বছর আগে বাংলাদেশের মাটিতে এসেছেন তিনি। সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অসহায়, দুস্থ মানুষের দিকে। বাইসাইকেল নিয়ে বাংলাদেশের মাঠ-ঘাট পেরিয়ে কাজ করছেন দরিদ্র মানুষের জন্য। বিলাসিতা ছেড়ে বেছে নিয়েছেন সাধারণ জীবন। সুদূর আমেরিকা থেকে এসেছেন নিঃস্বার্থ সেবা দেবেন বলে। আমেরিকার নাগরিক এ অকৃত্রিম বন্ধু ১৯৭৫ সাল থেকে মানুষের বিপদে পাশে দাঁড়ানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছেন। তাকে নিয়ে লিখেছেন রিফাত কান্তি সেন—
Advertisement
তার পুরো নাম রবার্ট বব হলেও সবাই তার নাম দিয়েছে ‘বব ভাই’। বয়স আশির কোটায়। চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। তবুও তার থামার নাম নেই। কাজ করে যাচ্ছেন অবিরত। ১১ বছর ফিলিপাইন থাকার পর খবরের মাধ্যমে জানতে পারেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের কথা। সে সময় বন্যা, দুর্ভিক্ষসহ একের পর এক মানবিক বিপর্যয়ের কথা শুনে হতাশ হন। তার মন কেঁদে ওঠে। মনে মনে ভাবেন, অসহায় মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ানো দরকার। তাই তিনি ছুটে আসেন বাংলাদেশে। এসেই মানুষের জন্য কাজ শুরু করেন। দিনের শুরুটা হয় তার বাইসাইকেলে। এভাবেই চলতে থাকে। এখন এটিই তার প্রতিদিনের কাজ। মানুষের দ্বারে দ্বারে সেবা পৌঁছে দেওয়ার মাঝে তিনি আনন্দ খুঁজে পান।
বব সাধারণত ১৫ বছরের নিচে এবং বয়স্ক মানুষকে সেবা দেন। ৪৪ বছর ধরে তিনি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ান। মাইলের পর মাইল বাইসাইকেলে চেপে গ্রামীণ অসহায় মানুষের খোঁজ-খবর নেন। কেউ অসুস্থ হয়ে চিকিৎসা নিতে অপারগ হলে তিনি চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করেন। এ ছাড়া রোগীর অপারেশনের ব্যবস্থাও তিনি নিজ খরচে করেন। তবে এতে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের সহায়তাও নিচ্ছেন।
রবার্ট বব এ পর্যন্ত ১৪টি জেলা ঘুরেছেন। তিনি বরিশাল, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, ফেনী, গাইবান্ধা, নড়াইল, নঁওগা, হবিগঞ্জ, শরীয়তপুর ও চাঁদপুর ঘুরেছেন। তিনি খ্রিষ্টান ফাদার হলেও এ পরিচয়টি বহন করেন না। ১৯৩৭ সালে জন্ম নেওয়া বব আমেরিকার ইন্ডিয়ানা শহরে বেড়ে ওঠেন। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ইন এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করেন।
Advertisement
তিন ভাই ও এক বোন তার। তবে পরিবার তাকে মানবসেবায় পুরো সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে। ৪৪ বছর ধরে অসংখ্য অসহায় মানুষের সেবায় অর্থ জোগান দিয়েছেন তার পরিবারের সদস্যরা। যখনই টাকার প্রয়োজন হয়েছে; পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি জন্ম নিয়েছেন মানুষের সেবা করার জন্য।
‘পরিবার ছেড়ে বাংলাদেশে থাকতে কষ্ট হয় না?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মোটেই না। আমি মনে করি, সবাইকে ভালোবাসা আমার কর্তব্য। জীবনের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে ভালোবাসা। আমি অসহায় মানুষগুলোর মাঝেই আমার পরিবারকে খুঁজে পাই।’ ‘এ কাজ করতে গিয়ে কোনো সমস্যা পোহাতে হয় কি-না?’ জানতে চাইলে বব বলেন, ‘অনেকে সন্দেহ করে। ভাবে, আমি খ্রিষ্টান। বিদেশ থেকে এসেছি। হয়তো ধর্মান্তরিত করতে এখানে এসেছি। আসলে এটা ঠিক নয়। আমি মনে করি, ধনী-গরিব সবারই এ কাজে এগিয়ে আসা উচিত। মানুষের সেবা করাও একটা ধর্ম। সেবা উত্তম ধর্ম। এটাকে ধর্মান্তরিত করা বলে না।’
খুব সাধারণ জীবন-যাপন করেন তিনি। নিজেই রান্না করে খান। খাবার তৈরিতে মসলাজাতীয় কিছুই ব্যবহার করেন না। সেদ্ধ খাবারই তার পছন্দ। ৮২ বছর বয়সী বব কোনো কমিউনিকেশন ডিভাইস ব্যবহার করেন না। তবে বিদেশে যোগাযোগের জন্য ফ্যাক্স ও মেইল ব্যবহার করেন। তবে সেটাও নিজের নয়। বন্ধু কিংবা দোকান থেকে পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেন তিনি।
রবার্ট বব বলেন, ‘আমি যখন অসুস্থ হয়ে যাই; ঠিক তখন কিছু বন্ধু আমার পাশে দাঁড়ান। আমার সেবা করেন। তারা এ দেশেরই মানুষ। আমি বাংলাদেশের মানুষকে বন্ধুর মতো ভাবি। তারা আমাকে বন্ধু জেনেই বিপদে পাশে দাঁড়ান।’
Advertisement
রবার্ট বব সবার মতো আত্মপ্রচারের পথ বেছে না নিয়ে নীরবে, নিভৃতে সেবা করে যাচ্ছেন। কাজ করে যাচ্ছেন স্বার্থের কথা চিন্তা না করে। ভবিষ্যৎ ইচ্ছার কথা জানতে চাইলে বব বলেন, ‘আমি এ বাংলাদেশের মাটিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। আমার শেষ দিনটি পর্যন্ত মানুষের সেবা করতে চাই।’
এসইউ/এমএস