মতামত

রাজাকারের তালিকা : বিতর্কের শেষ কোথায়?

প্রকাশ হতে না হতেই রাজাকারদের তালিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নামও যুক্ত হয়েছে। এটি সত্য কি মিথ্যা সেটা প্রমাণ হতে সময় লাগবে এবং এর মধ্যে সৃষ্ট হওয়া বিতর্ক নানা ধরনের গুঞ্জনও জন্ম দেবে। তবে বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জার। বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের ৪৮ বছর পরে হলেও রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করার মতো সাহসী পদক্ষেপ দেখাতে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সরকার। ইতিহাসের প্রয়োজনে রাজাকারদের তালিকা তৈরি করার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু আমলানির্ভর পদক্ষেপের কারণে এই শুভ ও সাহসী পদক্ষেপ নিয়ে ২৪ ঘন্টার ব্যবধানে বিতর্ক তৈরি হলো। যা কারো কাম্য ছিল না।

Advertisement

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার অনঢ় মনোভাবের কারণে দেশে যুদ্ধাপরাধীদের, রাজাকারদের বিচারের রায় কার্যকর ও বিচার প্রক্রিয়া চলমান রাখা সম্ভব হয়েছে। এই বিচার ঠেকাতে দেশী-বিদেশী নানা অপতৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল জামায়াত ও সঙ্গী বিএনপি নানাভাবে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে সক্রিয় ছিল। রাজনৈতিক মহলেও এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা মুখে অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলেন, প্রগতিশীল রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নেন, ভেতরে ভেতরে স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের সঙ্গে সখ্য রাখেন। এই পরিস্থিতিতে রাজাকারদের তালিকা প্রকাশের কাজটি করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট গবেষক বা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করা হলো না কেন সে প্রশ্ন স্বাভাবিক।

বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রগতিশীল ও প্রথিতযশা অনেক ব্যক্তির নাম এই রাজাকারের তালিকায় রয়েছে বলে জানা গেছে। বিজ্ঞমহল বলছেন এটি একটি অসংলগ্ন তালিকা। এ নিয়ে ক্ষোভ-বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। জ্ঞানীমহল যেমন বিতর্কে অংশ নিচ্ছে, তেমনি রাজনৈতিক মহলের অনেকেই এটি নিয়ে রঙ্গ-তামাশা করছে। তবে দায়িত্বশীল বিজ্ঞজনেরা তালিকা যাচাই-বাছাই ও পূণঃ পর্যালোচনার উপর গুরুত্বারোপ করছেন। এসব বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আবদুল আহাদ চৌধুরী বলেছেন, ‘কারা এটি করেছেন তা সনাক্ত করতে হবে।’ আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, এসব বিষয়ে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানিয়ে তালিকাটি যাচাইয়ের আশ্বাস দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত হয়তো যাচাই-বাছাই বা পর্যালোচনা হলো, কিন্তু তালিকা প্রকাশের পর বিতর্ক ও প্রশ্ন উত্থাপনের মাধ্যমে যে নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হলো তার দায় কে নেবে?

স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরে এ ধরনের একটি বড় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে সরকার বা মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল আরো বেশি সতর্ক হওয়া। অনেকেই বলছেন তালিকা তৈরির কাজে আমলাদের প্রাধান্য না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা বীরদের সার্বক্ষণিকভাবে সংযুক্ত করা হলে এ সঙ্কট তৈরি হতো না। শুধু কিছু শীর্ষ আমলা ও জেলা প্রশাসকেরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দায়িত্বটি পালন করেছেন বলে মনে হয় না। যদি সেরকম হতো তাহলে এ সঙ্কট তৈরি হতো না।

Advertisement

এই পরিস্থিতিতে খতিয়ে দেখতে হবে তালিকাটি তৈরির মানদণ্ড হিসেবে কোন উপাদানকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে? যারা এই তালিকা তৈরির কাজটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তারা আক্ষরিক অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাস করেন কি না? তালিকাটি তৈরি বা প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা বিশেষ কোনো মহলের সঙ্গে যোগসাজশ করেছেন কি না? একইসঙ্গে তালিকা তৈরির কাজে সংশ্লিষ্ট কারো দায়িত্বহীনতা, গাফিলতি, ভিন্নমহলের সঙ্গে যোগসাজশ বা অসৎ উদ্দেশ্যের বিষয়টি প্রমাণিত হলে দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরের সঙ্গে। তিনি বললেন, রাজাকারদের তালিকা তৈরির কাজটি আমলা বা জেলা প্রশাসকদের উপর ন্যস্ত করা ঠিক হয়নি। তিনিই জানালেন, এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট গবেষক বা প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করা হয়নি। তালিকাটি তৈরির আগে বা পরে সংশ্লিষ্ট গবেষক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কথা বললেন না কেন সেটিরও তদন্ত হওয়া দরকার। একইসঙ্গে তালিকাটি যাচাই-বাছাই করে চলমান বিতর্কের ইতি ঘটাতে হবে।

লেখক : বিশেষ সংবাদদাতা, দৈনিক যায়যায়দিন, সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।

এইচআর/পিআর

Advertisement