মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ আখ্যা দিয়ে জামায়াতের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার একটি রিপোর্ট নিয়ে যে তোলপাড় শুরু হয়েছে, সেটি নতুন কোনো বিষয় নয়। বরং সংগ্রাম প্রতি বছরই কাদের মোল্লা, মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিদদে ‘শহীদ’ উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ করে আসছিল। কিন্তু বিগত বছরগুলোয় এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হয়নি। এর কারণ সম্ভবত এই যে, এবার সংগ্রামের সংবাদটি প্রথমে কেউ একজন ফেসবুকে শেয়ার করেন এবং এরপরেই এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ফলে দেখা দরকার, অতীতেও সংগ্রাম এই ইস্যুতে কী ধরেনর সংবাদ করেছে, কেন করেছে এবং তাদের শহীদতত্ত্বের ব্যাখ্যাটাই বা কী?
Advertisement
সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের দেখা দরকার সংবাদপত্র আর দলীয় মুখপত্রের মধ্যে তফাৎ কী। সংবাদপত্র একটি বাণিজ্যিক/ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান—যেখানে মূলত সংবাদকর্মীরা কাজ করেন। সংবাদপত্রকে কিছু রাষ্ট্রীয় ও সম্পাদকীয় নীতিমালা মেনে চলতে হয়। যা খুশি তাই সে ছাপতে পারে না। সন্দেহ থাকলে যেকোনো তথ্য তাকে ক্রসচেক করতে হয়। সংবাদে ভারসাম্য বজায় রাখতে হয়। সব শ্রেণির পাঠকের রুচি ও অনুভূতির দিকে তাকে খেয়াল রাখতে হয়, সতর্ক থাকতে হয়। পক্ষান্তরে দলীয় মুখপত্রকে এতসব চিন্তা-ভাবনা না করলেও চলে। সেখানে যারা কাজ করেন তারা নিজেদের সংবাদকর্মী বলে পরিচয় দিলেও মূলত দলীয় নেতাকর্মী এবং তাদের পত্রিকার অফিসটি মূলত একধরনের দলীয় কার্যালয়।
তাদের টার্গেট পিপল বা উদ্দীষ্ট জনগোষ্ঠী দলীয় নেতাকর্মী এবং সেই সুবাদে অন্য কেউ যদি পড়েন, সেটি বাড়তি পাওনা। দলীয় মুখপত্রের মূল উদ্দেশ্য দলের আদর্শ ও কর্মসূচিসমূহ জানানো এবং সেই আলোকে কী কী কর্মপন্থা গৃহীত হয়েছে বা হবে তার বিবরণ দেয়া। দলের নেতারা কোথায় কী করলেন, করবেন, কোনো নির্দেশনা আছে কি না—ইত্যাদি প্রকাশই দলীয় মুখপত্রের উদ্দেশ্য। স্বভাবতই সেখানে প্রতিপক্ষ দলের বিষোদ্গার, নিজেদের দলের নেতাদের প্রশংসা এবং তাদের দল ও দলের নেতারা কেন অন্য দল ও নেতাদের চেয়ে উত্তম, সেটি বোঝানোর প্রচেষ্টাও দলীয় মুখপত্রের থাকে। যেহেতু তাকে কোনো সম্পাদকীয় নীতিমালা মেনে চলতে হয় না, ফলে সব শ্রেণির পাঠকের রুচি ও অনুভূতি নিয়ে তাকে খুব একটা ভাবতে হয় না।
কিন্তু সমস্যা হলো, দৈনিক সংগ্রাম জামায়াতে ইসলামির মুখপত্র হলেও এর বিষয়বস্তু ও পৃষ্ঠাবিন্যাস দৈনিক পত্রিকার মতোই। যিনি এটি জানেন না বা ধরা যাক বাংলাভাষী কোনো একজন বিদেশি যদি সংগ্রাম পত্রিকাটি নিয়ে পড়তে শুরু করেন, তাহলে তিনি প্রথমেই এটি বুঝে উঠতে পারবেন না যে, এটি একটি উগ্রপন্থি দলের মুখপত্র। অর্থাৎ সংগ্রামকে সবাই দলীয় মুখপত্র হিসেবে চিনলেও তারা নিজেরা এমন একধরনের ক্যামোফ্লাজ তৈরি করে রাখে যাতে মানুষ বিভ্রান্ত হয়। রাজধানীর যে এলাকায় আমি থাকি, সেই রাস্তার পাশের দেয়ালে নিয়মিতই সংগ্রাম পত্রিকা আঠা দিয়ে লাগানো হয় এবং দেখি যে অনেকেই সেই পত্রিকার খবর পড়েন। এর মধ্যে কিছু মানুষও যদি সংগ্রামে প্রকাশিত খবর বিশ্বাস করেন এবং কাদের মোল্লার মতো যুদ্ধাপরাধীদের নামের সঙ্গে শহীদ শব্দটি দেখে বিভ্রান্ত হন, সেটিই সংগ্রামের সাফল্য। এসব মুখপত্রের একটা বড় উদ্দেশ্যই থাকে, প্রচলিত ধারণা ও বিশ্বাস সম্পর্কে মানুষকে ধোঁয়াশার মধ্যে রাখা; ক্যামোফ্ল্যাজ তৈরি করা।
Advertisement
তবে দলীয় মুখপত্র আর সংবাপত্রের মধ্যে যে তফাৎ আছে, সেটি জামায়াতের মালিকানাধীন আরেকটি পত্রিকা নয়া দিগন্তের সাথে সংগ্রামের তুলনা করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যেহেতু দৈনিক সংগ্রাম হচ্ছে জামায়াতের দলীয় মুখপত্র, ফলে এখানে তারা তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া নেতাদের শহীদ বলে উল্লেখ করে। শুধু এবারই নয়, ২০১৭ সালের ২৪ নভেম্বর সংগ্রামের একটি সংবাদের শিরোনাম: ‘শহীদ মুজাহিদ আপোষহীন সংগ্রামের এক প্রতিচ্ছবি’। অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা আলী আহসান মুজাহিদকেও ‘শহীদ’ বলে উল্লেখ করে। ২০১৭ সালের ১১ মে সংগ্রামের শিরোনাম: ‘মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর প্রথম শাহাদাবার্ষিকী আজ’। গত ১২ মে সংগ্রামে শিরোনাম: ‘শহীদ মাওলানা নিজামী রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার’। গত ২২ নভেম্বর সংগ্রামের আরেকটি খবরের শিরোনাম: ‘আলী আহসান মুজাহিদের চতুর্থ শাহাদাতবার্ষিকী আজ’। দেখা যাচ্ছে, নিজামী-মুজাহিদ বা কাদের মোল্লাকে দৈনিক সংগ্রাম শুরু থেকেই ‘শহীদ’ হিসেবে উল্লেখ করে আসছে।
পক্ষান্তরে দৈনিক নয়া দিগন্তও জামায়াতের মালিকানাধীন হওয়া সত্ত্বেও এই পত্রিকায় নিজামি মুজাহিদ বা কাদের মোল্লাকে তারা সরাসরি ‘শহীদ’ বলে উল্লেখ করে না। গত ২ সেপ্টেম্বর নয়া দিগন্তের মালিক মীর কাসেম আলীর মৃত্যুর বিষয়ে পত্রিকার কৌশলী সংবাদ শিরোনাম ছিল : ‘মীর কাসেম আলীর মৃত্যুবার্ষিকীতে জামায়াতের বক্তব্য’। প্রতিবেদনে মীর কাসেম আলীর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে জামায়াতের আমির যে বিবৃতি দিয়েছেন সেটি হুবহু তুলে দেয়া হয়। তবে শিরোনামে কাসেম আলীকে ‘শহীদ’ বলে উল্লেখ করা হয়নি। বরং মীর কাসেম আলীকে বিশিষ্ট ইসলামী অর্থনীতিবিদ, সমাজসেবক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং জামায়াতের আমিরের বক্তব্য উদ্ধৃত করে লেখা হয়, ‘শহীদ মীর কাসেম আলী ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ।’ অর্থাৎ নয়া দিগন্ত নিজে ‘শহীদ’ শব্দটি না লিখলেও এখানে জামায়াতের আমিরের বক্তব্য কোট করে ‘শহীদ’ লিখেছে।
পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর নয়া দিগন্তের শিরোনাম: ‘মীর কাসেম আলীর অবদান জাতি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে : মকবুল আহমাদ’। এই প্রতিবেদনেও জামায়াতের আমির মকবুল আহমাদের উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা হয়, ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য, বিশিষ্ট সমাজসেবক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মীর কাসেম আলীকে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যা মামলায় দণ্ডিত করে হত্যা করেছিল। প্রতিবেদনে সুকৌশলে লেখা হয় ‘মীর কাসেম আলীকে শহীদ উল্লেখ করে জামায়াত আমির বলেন, তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে’। অর্থাৎ এখানেও নয়া দিগন্ত কর্তৃপক্ষ মীর কাসেম আলীকে ‘শহীদ’ বলার সরাসরি দায় নেয়নি।
যে ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রামের সংবাদ শিরোনাম নিয়ে বিক্ষোভ হলো, সেদিন নয়া দিগন্তের শিরোনাম ছিল: ‘কাদের মোল্লা দুনিয়ায় ন্যায়বিচার পাননি আখেরাতে অবশ্যই পাবেন- ডা: শফিক’। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বিবৃতি উল্লেখ করে এই সংবাদে লেখা হয়, কাদের মোল্লা ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ। তার ‘শাহাদত’ কবুল করার জন্য ডা. শফিক আল্লাহর কাছে দোয়া করেছেন বলেও সংবাদে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ এখানেও নয়া দিগন্ত শাহাদাতের বিষয়টি কোট আনকোট রেখেছে। নিজেরা দায় নেয়নি।
Advertisement
তবে সংগ্রাম শুধু এই সময়ে এসেই যে তাদের নেতাদের শহীদ আখ্যা দিচ্ছে তা নয়, বরং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়েও তাদের কী ভূমিকা ছিল তাও এই প্রজন্মের অজানা নয়। মুক্তিযুদ্ধে গণমাধ্যমের ভূমিকা শীর্ষক বইপত্রে তার বিস্তারিত বিবরণ তো রয়েছেই, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রকাশিত সংগ্রাম পত্রিকার সংখ্যাগুলো প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) এবং বাংলা একাডেমির আর্কাইভেও সংরক্ষিত আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগ্রাম পত্রিকায় জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম (যুদ্ধাপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত, মৃত্যু ২৩ অক্টোবর ২০১৪) এবং জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য নিয়মিত প্রকাশিত হত। মুক্তিযুদ্ধকে ব্যর্থ করে দেয়া তথা এই যুদ্ধকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র উল্লেখ করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করাই ছিল সংগ্রামের লক্ষ্য।
এ বিষয়ে তারা নিয়মিত প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয় প্রকাশ করতো। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারেও ১৯৭১ সালে প্রকাশিত সংগ্রাম পত্রিকার অসংখ্য সংবাদ রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুর্ভাগ্য হলো, আর্থিক সংকটে যখন সারা দেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনগুলো খাবি খাচ্ছে, দেশের শীর্ষ স্থানীয় সংবাদমাধ্যম থেকেও ব্যাপক ছাঁটাই হচ্ছে, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে এবং বন্ধের উপক্রম হয়েছে, সেই সময়েও সংগ্রামের মতো পত্রিকা টিকে আছে। কারণ যেহেতু এটি দলীয় মুখপত্র, ফলে দল থেকেই এটির খরচ নির্বাহ করা হয়। আবার জামায়াতে ইসলামির সঙ্গে যেহেতু আন্তর্জাতিক বিশ্বেরও যোগাযোগ আছে, ফলে তারা বিদেশ থেকেও আর্থিক সহায়তা পায় কি না, পেলে সেটির পরিমাণ কত, এখন বোধ হয় সেই হিসাবও বের করার সময় এসেছে।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।
এইচআর/জেআইএম