বিশেষ প্রতিবেদন

নাগরিকত্ব আইনে ভারত নিজেরই বিশাল ক্ষতি করে ফেলেছে

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন। আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক। সাবেক নির্বাচন কমিশনার। গবেষণা করছেন এবং লিখছেন নিরাপত্তা, রাজনীতির নানা বিষয় নিয়ে।

Advertisement

ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন এবং আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন জাগো নিউজের। ভারত পরিস্থিতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, দেশটির চলমান পরিস্থিতি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার সম্প্রীতি বিনষ্ট করবে। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধেরও আশঙ্কা প্রকাশ করেন এই বিশ্লেষক। আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার বিশেষ চাপে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ পড়ুন প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে বিতর্ক চরমে। আন্দোলন হচ্ছে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায়। নাগরিকত্ব আইনকে মুসলিমবিরোধী হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন অনেকেই। ভারত পরিস্থিতি আপনি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন? এম সাখাওয়াত হোসেন : নাগরিকত্ব আইনের মাধ্যমে ভারত নিজেরই বিশাল ক্ষতি করে ফেলেছে। ভারতে নাগরিকত্ব পাওয়া নিয়ে যে সংস্কৃতি ছিল, তা অনেকাংশেই নষ্ট করে ফেলল তারা। আমরা উত্তর-পূর্ব ভারতে ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ-সংঘাত দেখতে পাচ্ছি। মুসলমানদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। গরিব মুসলমানদের কী হবে, যাদের কোনো কাগজপত্র নেই, অথচ দীর্ঘদিন ধরে ভারতে বসবাস করে আসছে?আমার মতে, ভারতের জন্য এটি একটি ভয়ঙ্কর খারাপ সিদ্ধান্ত। ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে রূপ দিতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। ভারত নিজের জন্যও বড় ক্ষতি করে ফেলছে। এই ক্ষতির প্রভাব পড়বে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়

Advertisement

জাগো নিউজ : মোদি সরকারকে এ পথে হাঁটতে হচ্ছে কেন? এম সাখাওয়াত হোসেন : নরেন্দ্র মোদি সরকার এমন পথে হাঁটার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। বিজেপি মূলত উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তির ওপর ভর করে রাজনীতি করে। আর এখন যারা বিজেপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছেন। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহসহ অনেক নেতাই দেশভাগের বিরোধিতা করে বক্তব্য দিচ্ছেন। দেশভাগের জন্য কংগ্রেসকে দুষছেন। এসব কথা এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের কথা বলেই নির্বাচনে লড়েছেন। এই প্রক্রিয়ায় সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোও বিজেপিকে সহায়তা করেছে। গত নির্বাচনের আগে দুটি বিষয়ে ভর করে বিজেপি। একটি হচ্ছে পাকিস্তানবিরোধী অবস্থান, আরেকটি হচ্ছে চরম হিন্দুত্ববাদ। এই দুটি বিষয়কে কাজে লাগিয়ে দারুণ ফল পেল নির্বাচনে। আর এখন ক্ষমতা আরও পোক্ত করতে হিন্দুত্ববাদে আরও নির্ভর করতে হচ্ছে। নাগরিকত্ব আইন হিন্দুত্ববাদেরই অংশ। আজ হোক কাল হোক এটি বিজেপিকে করতেই হতো।

জাগো নিউজ : বিজেপি হিন্দুত্ববাদকে ধারণ করে রাজনীতি করছে শুরু থেকেই। এবার নির্বাচনে জয়ের পর হিন্দুত্ববাদের প্রকাশ ঘটাচ্ছে দ্রুত। এর কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন? এম সাখাওয়াত হোসেন : ভারতে অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। বলতে পারেন, এই উপমহাদেশের মধ্যে ভারতে অর্থনৈতিক মন্দাভাব তীব্র হচ্ছে। জিডিপি ৭.২ ঘোষণা করেছিল। এটি এখন ৪.২ এসে ঠেকছে। অর্থনীতি বিশ্লেষকদের কথা, জিডিপি আরও নামতে পারে। দেশটিতে গরিব আরও গরিব হচ্ছে, ধনী আরও ধনী হচ্ছে। সেখানকার বেশিরভাগ অর্থ অল্পসংখ্যক মানুষের হাতে এবং তারাই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যদিও একই চিত্র গোটা বিশ্বেই। এ অবস্থায় মানুষকে একটু সান্ত্বনা দিতে হয়। সামরিক সরকারও তাই করে। ধর্মকে পুঁজি করে ক্ষমতায় থাকে। মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশেও তাই দেখেছি। বাংলাদেশে এখনো দেখছি। মনস্তত্ত্ব দখলে ধর্মকে খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। হাজার বছর ধরে তা-ই হয়ে আসছে।ধর্মকে সামনে এনে রাজনীতি করলে, অন্যান্য বিষয় নিয়ে মানুষকে চুপ রাখা যায়। মূলত, ভারতে অর্থনৈতিক মন্দা ঢাকতেই নাগরিকত্ব আইন।

জাগো নিউজ : ধর্মীয় কারণের পাশাপাশি অনেকে রাজনৈতিক কারণও সামনে আনছেন এনআরসি (জাতীয় নাগরিকপঞ্জি) তৈরির প্রেক্ষাপট হিসেবে। বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যগুলোতে রাজনৈতিক প্রভাবটাই বেশি…।এম সাখাওয়াত হোসেন : হ্যাঁ। সবই তো রাজনীতির জন্যই। ভারতে সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তিনটি রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু এবং উত্তর প্রদেশের ফলাফল অনেক কিছুই নির্ভর করে সরকার গঠনের ক্ষেত্রে। পশ্চিমবঙ্গ তিন দশকেরও বেশি সময় বামপন্থিরা ক্ষমতায় ছিল। তারা ধর্মতত্ত্ব থেকে রাজনীতি আলাদা করে রেখেছিল। দেড় দশক ধরে তৃণমূল ক্ষমতায়। তৃণমূল মুসলমান ভোট ব্যাংককে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় থাকছে। এটিকে ধর্মীয় ইস্যু মনে করছে বিজেপি। এবারের জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল তা-ই প্রমাণ করে। ২০২১ সালের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি যেকোনো মূল্যে পশ্চিমবঙ্গে হানা দেবে। এ কারণেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এনআরসি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। মন্দা অর্থনীতিকে আড়ালে রাখা, হিন্দুত্ববাদের প্রকাশ এবং রাজনৈতিক বলয় তৈরি- এই তিন প্রধান কারণেই মোদি সরকার এনআরসি এবং নাগরিকত্ব সংশোধন আইন করেছে। এই সংকট কাটিয়ে উঠে হয়ত সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দও বাতিল করার উদ্যোগ নেবে বিজেপি। এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বিজেপি আগামী টার্ম ফের ক্ষমতায় আসবে এবং পরবর্তীতে আরও শক্ত অবস্থান নিতে পারে। যদি বিরোধী শক্তি নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে না পারে।

জাগো নিউজ : এই পরিস্থিতি রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে কোথায় নিয়ে যাবে? এম সাখাওয়াত হোসেন : দ্বন্দ্ব-সংঘাত থাকলেও ভারতীয় সংস্কৃতিতে এক ধরনের সম্প্রীতি ছিল। এই সম্প্রীতি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করেছে বিজেপি সরকার। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে ভারতের পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে। উত্তর-পূর্ব ভারতে এক সময় খুবই সংঘাত ছিল। মাঝখানে পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল। এখন ফের সংঘাত। সেনা মোতায়েন হয়েছে। এই পরিস্থিতি আসলে কোন দিকে যাবে, বলা মুশকিল। উত্তর-পূর্ব ভারতে সংঘাত নিরসনে বাংলাদেশের ভূমিকা আছে। কিন্তু সবসময় যে বাংলাদেশের সহায়তায় কাজে আসবে তা নয়। মিয়ানমারকে আমলে না নিলেও চীন এসব রাজ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’ ৬২ সালের পর সেভেন সিস্টার্সে যে সংঘাত হয়েছে, তার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সম্পৃক্ততা মেলে। এখন চীন সরকার এসবে নজর রাখে।

Advertisement

জাগো নিউজ : কিন্তু চীন সরকার তো এখন বাণিজ্যে গুরুত্ব দিচ্ছে… এম সাখাওয়াত হোসেন : হ্যাঁ। চীন এখন বিশ্বে অর্থ-বাণিজ্যের দিকেই বেশি ঝুঁকছে। তার মানে এই নয়, চীন উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে নজর সরিয়ে রেখেছে। উত্তর-পূর্ব ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে চীনের সম্পর্ক এখনো থাকতেই পারে। সার্বিক পরিস্থিতি যদি আপনি আমলে নেন তাহলে দেখবেন, ভারতের মধ্যকার নিজস্ব কাঠামো কোনো না কোনোভাবে ভেঙে যাওয়ার শঙ্কা আছে। যার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার ওপরও দেখতে হবে হয়তো।

এএসএস/এইচএ/জেআইএম