গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়নের কেশরিতা এলাকায় লাক্সারি ফ্যান কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত ১০ জনের মধ্যে প্রায় প্রতিটি পরিবারই তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়েছে। হাসপাতাল থেকে নিহতদের মরদেহ নিতে আসা স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
Advertisement
সোমবার (১৬ ডিসেম্বর) গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়নের কেশরিতা ও শ্রীপুরের মারতা গ্রামের তিনটি পরিবারের লোকদের সঙ্গে এবং হাসপাতাল এলাকায় একজনের পরিবারের সঙ্গে কথা হয়।
>> অভাবের সংসারে সুখ এনে দিতে চেয়েছিল ফরিদ :
ফরিদের বয়স ১৫ বছর। রংপুর সিটি কর্পোরেশনের কাচুবকুলতলা এলাকার তাজুল ইসলামের ছেলে সে। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে ফরিদ ছিল মেজো। পরিবারের অভাব লাঘব করে সংসারে সুখ এতে দিতে প্রায় চার বছর আগে অপ্রাপ্ত বয়সে ওই ফ্যান কারখানায় কাজ নিয়েছিল সে।
Advertisement
সংসারের অভাব দূর করতে আসা ফরিদ রোববার (১৫ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় লাক্সারি ফ্যান তৈরির কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়। তার সঙ্গে একইভাবে নিহত হন আরও নয়জন।
আগুনে নিহত শামীমের মায়ের আহাজারি
ফরিদের চাচা তাজ উদ্দীন জানান, তার বড় ভাই তাজুল ইসলামের নিজের জমি নেই। মায়ের জমি থেকে ২-৩ শতক জমি পাবেন তারা। অভাব-অনটনের সংসারে তাজুল ইসলাম তার স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে প্রায় ১০ বছর আগে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় আসেন। ছোট ফরিদ পরিবারের অভাব দূর করতে লাক্সারি ফ্যান কারখানার চাকরি নেয়। সে থাকত পাশের এক মেসে। অগ্নিকাণ্ডে ফরিদের মৃত্যুতে সব আশা নিভে গেল তাদের।
>> একমাত্র উপার্জনক্ষম শামীমকে হারিয়ে চোখে অন্ধকার দেখছে পরিবার :
Advertisement
পরিবারের একমাত্র ছেলে ও একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি শামীমকে হারিয়ে দু’চোখে অন্ধকার দেখছেন মা-বাবা। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে শামীম বড়। শামীম দুই বছর আগে বিয়ে করেন। তার ১০ মাস বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে। এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। অপরজন নবম শ্রেণিতে পড়ে। বৃদ্ধ বাবা নজরুল ইসলাম নবী কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। অভাবের সংসারে ছেলের উপার্জন তাদের একমাত্র ভরসা।
শামীমের মা ফাতেমা বেগম জানালেন, সকালে ছেলে মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেয়ে অফিসে যায়। সন্ধ্যায় প্রতিবেশীর মাধ্যমে কারখানায় আগুন লাগার খবর পাই। গিয়ে দেখি সব পুড়ে শেষ। শামীম লাশ।
>> উত্তমের উপার্জনই একমাত্র অবলম্বন পরিবারের :
কারখানায় কাজে যাওয়ার আগে সকালে মা তার ছেলে উত্তমকে দুধ দিয়ে মেখে ভাত খাইয়ে দিয়েছিলেন। যাওয়ার আগে উত্তম মাকে বলেছিল রাতে সে বাসায় ভাত খাবে না। বাড়ির পাশেই কীর্তন হবে সেখানে প্রসাদ খাবে। কিন্তু মা মিনা রানী জানতেন না ওই খাওয়াই তার ছেলের শেষ খাওয়া।
ফ্যান কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত উত্তমের বাড়িতে গেলে তার মা বিলাপ করে ছেলের বলে যাওয়া শেষ কথাগুলো বলছিলেন। উত্তমের মা মিনা রানী জানালেন তার একমাত্র ছেলে উত্তম ছিলেন সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। উত্তমের বাবা বীরবল বর্তমানে প্যারালাইজড অবস্থায় বাড়িতেই থাকেন। কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। উত্তমের একমাত্র বোন খুশি রানীর বিয়ে হয়েছে। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে মা বাবা বিলাপ করছেন। সন্তানের সঙ্গে শেষ স্মৃতিগুলো স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।
কিছুতেই কান্না থামছে না উত্তমের মায়ের
>> মায়ের হাতের পিঠা খেতে পারেননি রাশেদ মোল্লা :
গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়নের কেশরিতা গ্রামের কামাল হোসেনের একমাত্র ছেলে রাশেদ মোল্লা। তার চার ও দুই বছর বয়সী দুটি ছেলে সন্তান রয়েছে। বাবা কামাল একটি মোদি দোকানের ব্যবসা করেন। অভাবের সংসারে রাশেদ মোল্লা দুই বছর আগে চাকরি নেন লাক্সারি ফ্যান কারখানায়। তার দুটি ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সংসারের অভাব দূর করতে কারখানাটি বাড়ির কাছাকাছি থাকায় ছয় হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে আসছিল রাশেদ।
আগুনে নিহতের লাশ স্বজনদের হস্তান্তর
সোমবার সকালে রাশেদের বাড়িতে গেলে তার মা শাহনাজ বেগম জানান, রোববার সকালে ছেলে নাস্তা খেয়ে কারখানায় যায়। যাওয়ার সময় ছেলে রাতে বাড়ি এসে পিঠা খেতে চেয়েছিল। বিকেলে পিঠা বানানো শেষে সন্ধ্যায় তিনি কারখানায় আগুন লাগার খবর পান।
প্রতিবেশী জাকির বলেন, আগুন লাগার খবর পেয়ে আমার নিকট আত্মীয় আখতার হোসেন রাশেদকে ফোন দেয়। রাশেদ তখন তাকে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানায়। কিছুক্ষণ পরে মোবাইল ফোনে আর রাশেদকে পাওয়া যায়নি।
রোববার সন্ধ্যায় গাজীপুর সদর উপজেলার বাড়িয়া ইউনিয়নের কেশরিতা এলাকায় লাক্সারি ফ্যান কারখানার তিনতলায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে ১৯ শ্রমিকরে মধ্যে ১০ শ্রমিক ঘটনাস্থলেই নিহত এবং দুই শ্রমিক দগ্ধ হয়।
দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি) বি. জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম তরিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রীনা পারভীনসহ জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ঘটনা তদন্তে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
মো. আমিনুল ইসলাম/এএম/পিআর